পৃথিবীতে তিন রূপে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে এখনো ধুম্রজালে আচ্ছন্ন গবেষকরা। ভাইরাসটির গতি প্রকৃতি ও বিবর্তন একেক সময় একেক রকম। চীনে এ ভাইরাসটির প্রকৃতি এক রকম, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা স্পেনে ভাইরাসটির রূপ একেবারেই আলাদা। আবার এ ভাইরাসটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে আরেক রকম প্রকৃতি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। বলা যেতে পারে, বহুরূপী করোনা দেশ ভেদে তার রূপ পাল্টাচ্ছে মাত্র।

এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকরা মনে করছেন, কোভিড-১৯ এর উৎস ও গতিপ্রকৃতি জানতে হলে ভাইরাসটির বিবর্তন ভালো ভাবে জানা প্রয়োজন। বিবর্তন সঠিকভাবে না জানার কারণে এখন পর্যন্ত করোনার কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি গবেষকরা।

এ নিয়ে সম্প্রতি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানিয়েছে, গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত ১৬০টি ভাইরাল জিনোম পরীক্ষা করে মানবদেহে সংক্রমণের সময় ‘কোভিড-১৯’ এর বিবর্তন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন কয়েকজন গবেষক। ওই গবেষণায় কোভিড-১৯ এর তিনটি সংস্করণ শনাক্ত করা হয়।

এদিকে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা দলটির প্রধান পিটার ফরস্টার বলেছেন, দ্রুত মিউটেশন ক্ষমতার কারণে করোনাভাইরাস অল্প সময়ের মাঝেই ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। আর এ কারণেই ভাইরাস ও তার প্রতিষেধক শনাক্ত করা বেশ কঠিন।

ফরস্টার আরও বলেন, কোভিড-১৯ এর মতো কোনো ভাইরাসের সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। যে কৌশলের মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের প্রকৃতি নির্ণয় করা হয়। কোভিড-১৯ এর তিন ধরণের সংস্করণকে আমরা এ, বি ও সি নামে চিহ্নিত করছি।

কোভিড-১৯ বিষয়ে গবেষকরা জানিয়েছেন, টাইপ-এ করোনাভাইরাসের সঙ্গে বাদুড়ের দেহে পাওয়া ভাইরাসের অনেকটা মিল রয়েছে। তবে চীনের উহান শহর, যেখানে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে সেখানে টাইপ-এ কোভিড-১৯ ব্যাপক হারে ছড়ায়নি।

আবার চীনের উহানে থাকা এক মার্কিন নাগরিকের দেহে টাইপ-এ কোভিড-১৯ পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ায় কয়েকজন আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে টাইপ-এ ভাইরাস পাওয়া যায়।

গবেষকরা বলছেন, কোভিড-১৯ এর সাধারণ রূপটি হলো টাইপ-বি। গবেষকরা বলছেন, উহানে মূলত টাইপ-বি’র সংক্রমণ ঘটেছে। তবে পূর্ব এশিয়ার বাইরে অন্যান্য দেশে টাইপ-বি’র সংক্রমণ তেমনটা ঘটেনি। হতে পারে উহানের কঠোর প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে টাইপ-বি ভাইরাস এই অঞ্চলের বাইরে যেতে পারেনি।

অন্যদিকে কোভিড-১৯ এর টাইপ-সি’র সংক্রমণ ঘটেছে ইউরোপের (ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন ও ইংল্যান্ড) বিভিন্ন দেশে। এছাড়া চীনের মূল ভূখন্ডের রোগীদের কারো শরীরে টাইপ-সি কোভিড-১৯ পাওয়া যায়নি। তবে সিঙ্গাপুর, হংকং ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তদের কয়েকজনের শরীরে তা পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, কোভিড-১৯ এর টাইপ-এ’র সঙ্গে বাদুড় ও বনরুইয়ের শরীরে পাওয়া ভাইরাসের মিল আছে। দুই বার মিউটেশনের পর টাইপ-এ থেকে টাইপ-বি’তে পৌঁছেছে কোভিড-১৯। অন্যদিকে টাইপ-সি অনেকটা টাইপ-বি’র সন্তানের মতো।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফরস্টার আরও বলেন, উহানে টাইপ-বি ভাইরাস পরিবেশগভাবে অভিযোজনের মাধ্যমে কিংবা ভাইরাসের দৃঢ় প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে পূর্ব এশিয়ার মানুষের শরীরে ছড়িয়েছে। প্রাথমিকভাবে পূর্ব এশিয়ায় যতো দ্রুত এই ভাইরাসের মিউটেশন হয়েছে অন্যান্য অঞ্চলে সেভাবে হয়নি।

ফরস্টার বলেন, মানবদেহে সংক্রমণের শুরু থেকে ভাইরাসটি কতোবার গতিপ্রকৃতি বদল করেছে তা যেহেতু আমরা কিছুটা হলেও শনাক্ত করতে পেরেছি, তাই এই প্রক্রিয়ায় পরিসংখ্যানের তত্ত্ব প্রয়োগ করে করোনার সংক্রমণ কমানো যেতে পারে। এমনকি কোভিড-১৯ ভবিষ্যতে আবার ফিরে আসলেও সেটাকে দমন করা যেতে পারে।

এদিকে সান ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিশেষজ্ঞ লু জিয়াহাই জানিয়েছেন, শারীরিক গঠনে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ভাইরাসটি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সংক্রমিত হয়েছে। এটি মানবদেহে যত বেশি মানিয়ে নিয়েছে, সেটি তত বেশি শক্তিশালী হয়েছে।

লু জিয়াহাই বলেন, বিশ্বব্যাপী এই মহামারিকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। মানুষের উচিত ভাইরাসটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। এটি অত্যন্ত শক্তিশালী ভাইরাস।

 

টাইমস/এসএন/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ