করোনাভাইরাস যেহেতু চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাছে নতুন এবং এ নিয়ে এখনও অনেক তথ্যই আমাদের অজানা, তাই ভাইরাসটি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণারও ছড়াছড়ি। সব কটি ধারণার উৎপত্তিই যে অজ্ঞতা থেকে এমনটাও কিন্তু নয়। অনেক সময় করোনাভাইরাস সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষণায় বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক তথ্য উঠে এলেও পরবর্তীতে তা অন্য গবেষণায় বাতিল হয়ে গেছে। তাই কোভিড-১৯ সম্পর্কে সব সময় আপডেট তথ্য জেনে রাখা উচিত।
ভিটামিন-ডি কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধ করে
কিছু নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি ভিটামিন-ডি পরিপূরক গ্রহণ করেন তবে তার সার্স-কোভ-২ তে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কমে যায়। আসলে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা পরীক্ষামূলক গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে বলা হয়েছিল ভিটামিন-ডি এর ঘাটতি থাকলে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে।
গবেষণাপত্রটির লেখকরা দাবি করেছেন যে, কয়েকটি দেশের জনসংখ্যায় ভিটামিন-ডি এর নিম্ন-স্তরের মাত্রা এবং কোভিড-১৯ সংক্রমণের উচ্চ হার ও মৃত্যুর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে।
২০২০ সালের ১লা মে পূর্বে প্রকাশিত এই দাবিগুলির দ্রুত পর্যালোচনা করে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এভিডেন্স-ভিত্তিক মেডিসিনের গবেষকরা দ্ব্যর্থহীন সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। তারা জানান, “আমরা ভিটামিন-ডি কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করে সে সম্পর্কে কোনো ক্লিনিক্যাল প্রমাণ পাইনি।”
দস্তা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থামায়
আরেকটি ব্যাপক গুজব হলো- দস্তা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব বা এটি কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা করতে সক্ষম।
তবে এ কথা সত্য যে দস্তা একটি প্রয়োজনীয় খনিজ, যা মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। এই ধারণাটি থেকে রাশিয়া, জার্মানি ও গ্রীসের গবেষকদের একটি দল অনুমান করেছিলেন যে জিংক সম্ভবত কোভিড-১৯ এর জন্য প্রতিরোধমূলক এবং সহায়ক থেরাপিউটিক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হবে। তাদের প্রাথমিক গবেষণাটি আন্তর্জাতিক আণবিক মেডিসিন জার্নালেও প্রকাশিত হয়।
গবেষকরা যেসব ভিট্রো পরীক্ষাগুলি উল্লেখ করেছেন, তাতে স্পষ্টতই দেখা গেছিল যে দস্তার আয়ন সমূহ একটি নির্দিষ্ট এনজাইমের ক্রিয়া বাধা দিতে সক্ষম, যা সার্স কোভ-২ এর ভাইরাল কার্যকলাপকে সহজতর করে তোলে।
যাইহোক, তারা এটাও স্বীকার করেছে যে তাদের হাতে মানুষের উপর জিংক প্রয়োগ ও এর কার্যকারিতার বিষয়ে প্রকৃত ক্লিনিক্যাল প্রমাণের অভাব রয়েছে।
২০২০ সালের এপ্রিলে বিএমজে নিউট্রিশন প্রিভেনশন ও হেলথ জার্নালে প্রকালিশ এক গবেষণায় পুষ্টিবিদ এমা ডার্বিশায়ার (পিএইচডি) এবং জৈব রসায়নবিদ জোয়ান দেলাঞ্জ (পিএইচডি) এই দাবিকে নাকচ করে দেন। দস্তা সম্পর্কিত বিদ্যমান ডেটা পর্যালোচনা করে তারা বলেন, জিংক বা দস্তা পরিপূরক কম বয়সী বাচ্চাদের নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে এবং দস্তার অপ্রতুলতা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। তবে, তারা লক্ষ করেছেন যে, সাধারণভাবে ভাইরাল সংক্রমণ রোধে দস্তা পরিপূরকের ভূমিকা সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই।
ভিটামিন-সি কোভিড-১৯ এর সাথে লড়াই করতে পারে
ভিটামিন-সি হলো আরেকটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি, যা প্রচুর মনোযোগ পেয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, এটি ফ্লু বা সাধারণ সর্দি প্রতিরোধ, এমনকি নিরাময় করতে পারে।
যদিও এটি সত্য যে পর্যাপ্ত ভিটামিন-সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তবে সর্দি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা চিকিৎসা বা প্রতিরোধে এর কার্যকারিতা সম্পর্কিত দাবিগুলির পক্ষে প্রমাণ খুব সীমিত এবং প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ। তবুও, দাবি করা হচ্ছে যে, এই ভিটামিনটি নোভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করতে পারে।
বেসরকারিভাবে চীনে চলমান একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের উপর ভিত্তি করে মানুষ ভিটামিন-সি এর উপর খুব বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই গবেষণায় করোনা আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের উপর উচ্চ মাত্রার ইন্ট্রাভেনাস (ফোর) ভিটামিন-সি এর প্রভাবগুলি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। গবেষকরা আশা করছেন ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই পরীক্ষা শেষ হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, “(ফোর) ভিটামিন-সি এবং সাধারণ ভিটামিন-সি পরিপূরক এক জিনিস নয়।”
ভেষজ প্রতিকার সহায়তা করতে পারে
বিভিন্ন ভেষজ ওষুধ নোভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় সক্ষম এমন দাবিও প্রচলিত রয়েছে। ২০২০ সালের এপ্রিলে এক চীনা আধিকারিকের জারি করা একটি বিবৃতিতে বলা হয় যে, কিছু ভেষজ ওষুধ কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা করতে সহায়তা করতে পারে। যা ল্যানসেট ম্যাগাজিনে ১৫ই মে প্রকাশিত হয়।
এ বিষয়ে চীনের হাংজহু’র জেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অফ মেডিসিনের ঐতিহ্যবাহী চাইনিজ মেডিসিন বিভাগের লেখক ইয়াচাং ইয়াং সতর্ক করে বলেছেন, “যেকোনো ভেষজ ওষুধ থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাছাড়া কোভিড-১৯ প্রতিরোধ বা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভেষজ ওষুধের কার্যকারিতা সম্পর্কে এখনি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ মানব ট্রায়াল থেকে প্রাপ্ত প্রমাণগুলি খুব সীমাবদ্ধ।” তথ্যসূত্র: মেডিক্যাল নিউজ টুডে
টাইমস/এনজে/জিএস