সঙ্গীকে নিয়ে সুখে থাকার দার্শনিক ব্যাখ্যা

আমরা পৃথিবীতে এসেছি সুখে শান্তিতে থাকার জন্য। এই মানব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ভালো থাকা। এই ভালো থাকার সবচেয়ে বড় উপাদান হলো সঙ্গী। সবাই সঙ্গী চায়, নারী পুরুষের সঙ্গ পেতে চায়, পুরুষ নারীর সঙ্গ চায়, প্রেমিক প্রেমিকার সঙ্গ চায়, প্রেমিকা প্রেমিকের সঙ্গ চাই।

সত্যিই প্রিয় মানুষটির সঙ্গের মতো মধুর অনুভূতি আর কিছুতেই নেই। ভালোবাসার প্রিয় সঙ্গীর সাথে কথা বলা, ঘুরতে যাওয়া, আড্ডা দেওয়া, এটা সেটা খাওয়া, আদর করা, রোমান্স করার মতো আনন্দদায়ক সুখকর অভিজ্ঞতা আর কিছুতেই নেই। পৃথিবীতে সুখ বলে যদি কিছু থেকে থাকে এরই নাম প্রেম, এরই নাম ভালোবাসা। এই প্রিয়তমার প্রেমময় মিষ্টি কথা, মাতাল করা মনোমুগ্ধকর শরীরের গন্ধ, স্পর্শ, আদর, যত্ন, আন্তরিকতা, ত্যাগ তিতিক্ষা, তার সাথে সময় কাটানো ইত্যাদির সুখকর অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করেই লিখিত হয়েছে হাজারো রোমান্টিক নাটক, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, কাব্য কাহিনী। আমার কাছে জীবন মানেই হলো খাবার এবং ভালোবাসা (এই ভালোবাসা বলতে আমি যৌনতাকে বুঝাচ্ছি, নারী পুরুষের সঙ্গকে, রোমান্সকে বুঝাচ্ছি)। এই সুখকর অভিজ্ঞতা লাভ করতেই আমারা বিয়ে করি বা প্রেম করি। আমি আমার আলোচনায় বউ, বর, প্রেমিক, বা প্রেমিকা সবাইকে এক সাথে বুঝাতে গিয়ে সঙ্গী শব্দটি ব্যবহার করবো।

আমাদের জীবনে সঙ্গীর গুরুত্ব অপরিসীম। আপনার সঙ্গীর সাথে আপনার যদি কথায়, কাজে, আচরণে, চাওয়া পাওয়ায় ভারসাম্য থাকে আপনি হবেন চির সুখী একজন মানুষ। তাকে ছাড়া আপনি চলতেই পারবেন না, সে যদি আপনার পাশে ভালোবেসে আন্তরিকতার সাথে থাকে, আপনাকে সুন্দর সময় দেয় তাহলে আপনার দুনিয়াটা হবে জান্নাত। আপনি কাজে কর্মে, চিন্তা ভাবনায়, পড়াশুনায় সকল ক্ষেত্রে পাবেন স্বর্গীয় অনুভূতি। কিন্তু এই কাজটিই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। কারণ প্রতিটি মানুষ ভিন্ন, তাদের চাওয়া পাওয়া ভিন্ন, স্বপ্ন ভিন্ন। একেকটি মানুষ একেক ভাবে চিন্তা করে, একেক ভাবে থাকতে চায়। কিন্তু জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্যে হোক, মানসিক প্রশান্তির জন্যই হোক কিংবা পরিবার বা সমাজের কথা ভেবে বা ভালোবাসার মানুষটির কথা ভেবে আমাদের মানিয়ে চলছে হয়, সেক্রিফাইস করে চলতে হয়। তার ভালোবাসাময় সহযোগিতা ছাড়া আপনি সুন্দরভাবে চলতেই পারবেন না।

সঙ্গীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটলে যা হবে:

আপনার সঙ্গীর সাথে আপনার একটি মানসিক সম্পর্ক আছে। সে আপনার অভ্যাস, আপনি তার প্রতি আসক্ত। আপনি যদি আপনার সঙ্গীর সাথে ঝগড়া করেন, বিচ্ছেদ ঘটান, মনোমালিন্যতা তৈরি করেন তখন দেখবেন আপনার কিছু ভালো লাগছে না, খেতে মন চাইবে না, ঘুরতে মন চাইবে না, ঘুম আসবে না, আসে পাশে কাউকে সহ্য হবে না। পৃথিবীর সব কিছু তিত মনে হবে। আপনি অস্থির হয়ে যাবেন। প্রিয় বিচ্ছেদের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ পাগল হয়, আত্মহত্যা করে, মাদকাসক্ত হয়ে উঠে। বাবা মা মারা গেলে কেউ পাগল হয় না, আত্মহত্যাও করে না। কিন্তু প্রেম বিচ্ছেদের কারণে ঠিকই জীবন ধ্বংস হয়। এই প্রিয় বিচ্ছেদের কারণে হাজার হাজার ছেলে মেয়ে পড়াশুনার ছেড়ে দেয়। সুতরাং ভেবে দেখুন কতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আপনার সঙ্গী।

সুতরাং আপনি আপনার নিজের ভালোর জন্যই, নিজের সুখের জন্যই সঙ্গীর সাথে মিলে মিশে থাকতে চাইবেন। কারণ আপনি বুঝতে পারছেন সঙ্গীর গুরুত্ব অপরিসীম।

কিভাবে সঙ্গীর সাথে সুন্দর সম্পর্ক রাখবেন:

১) আপনার মাথায় সেট করে নিন আপনার সঙ্গী আপনার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাকে ছাড়া আপনার জীবন অপূর্ণ। তার সঙ্গ, আদর, সময়, অবদান ইত্যাদি আপনার জীবনকে সুন্দর করবে, সুখী করবে, ভালো রাখবে। মোট কথা সঙ্গী থাকার উপকারিতাগুলো মাথায় সেট করে নিবেন।

২) সঙ্গী ছাড়া আপনার চলবে না, তাকে আপনার দরকার আছে, সুতরাং যাকে আপনার দরকার আছে, তার সাথে ঝগড়া করে, ঝামেলা করে লাভ নাই। কারণ দিন শেষে আপনার ঠিকই তার সাথে মিলতে হবে।

৩) পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো সেই ব্যক্তি যে তার ঘরে ভালো, সঙ্গী আপনার ঘরের মানুষ, তার সাথে সবচেয়ে ভালো ব্যবহারটি করুন। ঘর ঠিক তো সব ঠিক।

৪) আপনি যদি নিজেকে শিক্ষিত ভাবেন তাহলে এই বিষয়টি মাথায় রাখুন শিক্ষিত ব্যক্তিরা কখনো ঝগড়া করে না, গালাগালি করে না, মারামারি করে না। বরং সমস্যাগুলোর আলোচনা করে সমাধান করে, যৌক্তিকভাবে সমস্যা ও সমাধান তুলে ধরে। বার বার সুন্দর করে বোঝানোর চেষ্টা করে। আর মারামারি, গালাগালি করে বর্বর মানুষগুলো।

৫) ঝগড়া করে, রাগ করে সঙ্গীকে দূরে রাখবেন না, বাপের বাড়ি পাঠাবেন না, এখন যে যুগ, চরম কম্পিটিশনের যুগ। চার দিকে অনেক মানুষ ফাঁদ পেতে বসে আছে আপনার সঙ্গীকে ভোগ করতে। যদি তারা শুনে যে আপনার সঙ্গীর বিচ্ছেদ হয়েছে তখন তারা সেই সুযোগে আপনার সঙ্গীকে কাবু করবে, আর আপনার সঙ্গীও তার মন ভালো রাখতে তাদের ফাঁদে পা ফেলবে। ফলে তৃতীয় পক্ষের আগমন ঘটবে।

৬) সঙ্গীকে ভালো করে জানুন। বোঝাপড়া বাড়ান, তার ভালো লাগা, মন্দ লাগার বিষয়গুলো জানুন, চেষ্টা করুন ভালো লাগার বিষয়গুলো করতে, আর তার মন্দ লাগার বা অপছন্দ বিষয়গুলো এড়িয়ে চলুন।

৭) ক্ষমা করতে শিখুন। সব মানুষের কিছু ভালো গুণ থাকে কিছু মন্দ গুণ থাকে। আপনি ভালো গুণগুলোর দিকে তাকিয়ে দোষ গুলো ক্ষমা করে দিন। আপনার সঙ্গীর ২৫ দিন আদর পেতে পারেন, আর ৫ দিন অত্যাচার সহ্য করতে পারবেন না, এটা কেমন বিচার বলুন। তবে মাসে ২৫ দিনই যদি অত্যাচার করে তাহলে তাকে ছেড়ে দিয়ে নতুন সঙ্গী খুঁজাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

৮) চুপ থাকতে শিখুন। যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়। একজন খেপলে বা বকাবকি করলে আরেকজন চুপ থাকুন। দুজন এক সাথে চেঁচামেচি করলে পরিস্থিতি চরম খারাপ হয়ে উঠবে।

৯) সদা ধৈর্যশীল হোন। আর রাগটা কমান। নিজের বাবা-মাকে এতো দিন রাগ দেখিয়েছেন বলেই যে বউ অথবা স্বামীর ওপরেও রাগ দেখাবেন সব সময় তা কখনই নয়। বাবা মা আপনাকে ছেড়ে যাবে না, কিন্তু আপনার বউ ঠিকই অত্যাচারিত হলে আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে। সে সুখ পেতে আপনার কাছে আসছে দুঃখ পেতে না ।

১০) সদা আনন্দে থাকুন। মজার মজার গল্প করুন, ঘুরতে নিয়ে যান, আদর করুন। এটা সেটা খাওয়ান, মুভি দেখুন, আর একটু ঝগড়া হলে চেষ্টা করুন তাড়াতাড়ি মিটিয়ে নিতে, চেষ্টা করুন সব সময়ই মুখে একটা প্লাস্টিক হাসি লাগিয়ে রাখতে। দেখবেন দাম্পত্য জীবনে আপনি সুখী হচ্ছেন।

১১) সঙ্গীর ভালো বন্ধু হোন, একটি ভালো বন্ধুই কিন্তু একটা ভালো বর হতে পারে, ভালো বান্ধবীই একটি ভালো বউ হতে পারে। আপনার সঙ্গী হয়ে উঠুক আপনার বেস্টফ্রেন্ড। শেয়ারিং, ক্যায়ারীং সব হোক না তার সাথে। একটি চমৎকার ক্যামেস্ট্রি তৈরি করুন তার সাথে।

১২) দায়িত্ববান হোন, "আই লাভ ইউ" মানে আমি তোমার প্রতি দায়িত্বশীল। তোমাকে ভালো রাখা আমার দায়িত্ব। আমি এমন কিছু করবো না, যা তোমাকে কষ্ট দিবে। আমি তোমার ভালো চাইবো। এই অনুভূতিটি হলো দায়িত্বশীল মানুষের অনুভূতি।

১৩) মিথ্যে কথা বলতে শিখুন। মীমাংসার জন্য, শান্তির জন্য মাঝে মাঝে মিথ্যে কথা বলা দোষের নয়। কোন ভালো কাজ করতে গেলে যদি মিথ্যে কথা একটু আধটু বলা হয় তাহলে বড় কোনো ভুল হবে না। ধরুন- বন্ধুদের সঙ্গে একটি পার্টিতে আপনি আছেন। সেখানে বলতেই পারেন অফিসের একটা খুব জরুরি মিটিং-এ আছেন।

১৪) সঙ্গীকে নেতিবাচকভাবে কারো সাথে তুলনা করবেন না। আপনি ভাবুন আর তাকে বলুন সে সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে ভালো মানুষ, তার সবকিছুই আপনার কাছে শ্রেষ্ঠ। একটি কথা মাথায় রাখবেন অভাব অসীম। পারফেকশনের শেষ নেই। আপনার কাছে যে আছে তাকেই শ্রেষ্ঠ ভাবুন। ঐশ্বরিয়া সুন্দরী তাতে আপনার কি, ঐশ্বরিয়া কিন্তু আপনার না।যে আপনার তাকে নিয়েই থাকুন।

তবে যদি এতো কিছুর পরেও আপনি সঙ্গীকে নিয়ে ভালো না থাকতে পারেন, সুখী না হোন তবে সঙ্গী পরিবর্তন করুন। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।

লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক দেখে বিএনপির মাথা খারাপ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী May 18, 2024
img
কেন্দ্র দখলতো দূরের কথা, একটি জাল ভোট পড়লেও কেন্দ্র বন্ধ : ইসি হাবিব May 18, 2024
img
আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম May 18, 2024
img
ইন্টারনেট ব্যবহারে এশিয়ায় বেশি পিছিয়ে বাংলাদেশের নারীরা May 18, 2024
img
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা নেই : খুরশিদ আলম May 18, 2024
img
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকরা কেন ঢুকবেন, প্রশ্ন ওবায়দুল কাদেরের May 18, 2024
img
দুই জেলায় বজ্রপাতে ৫ জনের মৃত্যু May 18, 2024
img
স্বাধীনতাবিরোধীরা সুযোগ পেলেই ছোবল মারতে চায় : রাষ্ট্রপতি May 18, 2024
img
সরকারের ধারাবাহিকতার কারণে এত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে : কাদের May 18, 2024
img
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবল ঝড়ে সাতজনের প্রাণহানি May 18, 2024