শরীরচর্চা চলাকালে বা আগে ও পরে আপনি যা গ্রহণ করবেন তা আপনার শরীরচর্চার ফলাফল ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক করতে কিংবা শারীরিক ফিটনেসকে প্রভাবিত করতে সক্ষম, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই অবগত আছেন। পুষ্টিবিদদের মতে, শরীরচর্চার পূর্বে মানসম্পন্ন কার্বোহাইড্রেট এবং পরে চর্বিহীন প্রোটিন গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শরীরচর্চার পূর্বে কি খাওয়া উচিত?
ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিভাগের অধ্যাপক ন্যান্সি কোহেনের মতে, ব্যায়াম শুরুর পূর্বে পরিমিত পরিমাণে কার্বস বা শর্করা গ্রহণ করুন, তবে খুব বেশি মাত্রায় নয়। যদি কেউ এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শরীরচর্চা করেন তবে শারীরিক ওজন অনুযায়ী প্রতি ২.২ পাউন্ডের জন্য ১-৪ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করতে পারেন। একটি মাঝারি আকারের কলাতে মোট কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ ২৭ গ্রাম।
আমেরিকান ডায়েটারি গাইডলাইনস অনুযায়ী, আপনি যদি দিনে ২০০০ ক্যালরি গ্রহণ করেন থাকেন তবে তার মধ্যে ২২৫-৩২৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু কখন তা গ্রহণ করা উচিত? কোহেনের পরামর্শ অনুযায়ী ওয়ার্ক-আউটের কমপক্ষে ১-৪ ঘণ্টা আগে তা গ্রহণ করতে হবে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, কার্বোহাইড্রেট অনুশীলনে ধৈর্যশীলতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ২০১১ সালে জার্নাল অব নিউট্রিশনে পেপারটি প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকরা পূর্ববর্তী আরও ৫০টিরও বেশি কার্বহাইড্রেট সংক্রান্ত গবেষণা পর্যালোচনা করেছেন। এ থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত থেকে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, কার্বোহাইড্রেট প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে শরীরচর্চার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
মানসম্মত কার্বস অনুশীলনের কর্মক্ষমতা বাড়ায়, বিশেষ করে ধৈর্যশীল অনুশীলনকে প্রভাবিত করে, এ সংক্রান্ত গবেষণা ১৯৩০ এর দশক থেকেই চলে আসছে।
যেসব কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারে কম চর্বি এবং স্বল্প বা মাঝারি মাত্রার আমিষ, তা গ্রহণের মধ্য দিয়ে আপনি শারীরিক ক্রিয়াকলাপের জন্যে প্রয়োজনীয় গ্লাইকোজেন নিশ্চিত করতে পারেন। এক্ষেত্রে সল্প ফ্যাটযুক্ত গ্রানোলা বার, ডুমুর, চিনাবাদাম, মাখন জেলি, স্যান্ডউইচ, কলা, দই, পাস্তা এবং অন্যান্য উচ্চ কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন কহেন।
তিনি আরও বলেন, ব্যায়ামের সময় পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ার্ক-আউটের ২-৪ ঘণ্টা আগে আপনার শরীরের মোট ওজন অনুযায়ী প্রতি ১ কিলোগ্রাম ওজনের জন্য ৫-১০ মিলিলিটার পানি পান করতে পারেন।
তবে সকালে ওয়ার্ক-আউটের পূর্বে কিছু খাওয়া উচিত কিনা এনিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতভেদ রয়েছে। কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টুয়ার্ট ফিলিপসের মতে, ব্যায়ামের পূর্বে কিংবা পরে সকালের নাস্তা গ্রহণ উচিত কিনা এ বিষয়ে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হবে।
তিনি বলেন, “আমি প্রতিদিন সকালের খাবারের পূর্বে ওয়ার্ক-আউট করতে পছন্দ করি। বেশিরভাগ সময়ই ওয়ার্ক আউটের পূর্বে এক কাপ কফি বা এক টুকরো টোস্ট ছাড়া কিছুই গ্রহণ করি না। এটা ভালো কিংবা খারাপ সেটা বলতে চাইছি না। তবে আমি এটি করে থাকি।”
অন্যদিকে কোহেনের মতে, খালিপেটে ব্যায়ামের অভ্যাস না করাটা জরুরি। সাধারণত, শারীরিক ক্রিয়াকলাপের ফলে গ্লাইকোজেন ভেঙে শরীরে প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ সরবরাহ করে। দীর্ঘসময় উপোষ থাকার ফলে পেশিতে গ্লাইকোজেন শীঘ্রই হ্রাস পায়। এতে চর্বি ভেঙে পড়ে। এটি রক্তে ক্যাটোসিস বা ক্যাটো অ্যাসিড তৈরি করতে পারে যা দীর্ঘমেয়াদী ক্লান্তি, মাথাঘোরা এবং কিডনির জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ক্লান্তিজনিত কারণে যদি আপনি সম্পূর্ণ অনুশীলন শেষ করতে না পারেন তবে আপনি ওয়ার্ক-আউটের কার্যকরিতা ধরে রাখতে পারবেন না।
সকালে ওয়ার্ক-আউট কার্যকর করে তুলতে ডিম, সিরিয়াল, দুধ, মাখন, টোষ্ট এবং দই খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কোহেন।
ওয়ার্ক-আউট চলাকালে কি খাবেন?
ওয়ার্ক-আউট চলাকালে সবচাইতে বেশি প্রয়োজন নিজেকে হাইড্রেট বা আর্দ্র রাখা। ওয়ার্ক-আউটের সময়কাল যদি ৪৫ মিনিট বা তার থেকে কম হয় তবে এর জন্যে শুধু পানিই যথেষ্ট।
কোহেনের মতে, ১-৩ ঘণ্টা ব্যায়ামের জন্যে ৩০-৬০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করতে হবে। ব্যায়ামকে কার্যকর করে তুলতে এটি পেশিতে গ্লাইকোজেন সরবরাহ করবে। একটি মাঝারী আপেলে মোট ২৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে।
খেলাধুলার ক্ষেত্রে এবং ব্যক্তি স্বাচ্ছন্দ্যের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন খাবার বা পানীয় কার্যকরী হতে পারে। যেমন জুস, স্পোর্টস ড্রিঙ্কস, গ্রানোলা বার, ফল এবং অন্যান্য উচ্চ-কার্বোহাইড্রেট সম্পন্ন খাবার ও পানীয় সহায়ক হতে পারে।
তরলজাতীয় খাবার সহজে হজম হয় বলে মত প্রকাশ করেছেন মি. ফিলিপস। তার মতে, “কঠিন খাদ্য হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং তা অনেকের জন্যে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে তরল জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা যেতে পারে।”
ওয়ার্ক-আউট পরে কি খাবেন?
কোহেনের মতে, ব্যায়াম বা ওয়ার্ক-আউটের পরে প্রোটিন গ্রহণ করুন, যেমন দুগ্ধজাত পণ্য, ডিম, মাংস এবং হাঁস-মুরগি প্রভৃতি। দীর্ঘ বা উচ্চ-তীব্রতার ওয়ার্ক-আউট শেষে শরীরের ওজন অনুসারে প্রতি ১ কিলোগ্রাম ওজনের জন্য প্রতি ঘণ্টায় ১-১.২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট চার থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত গ্রহণ করুন এবং প্রথম ১ ঘণ্টার মধ্যেই ১৫-২৫ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করুন। এটি পেশিতে প্রোটিন সংশ্লেষণে সহায়তার পাশাপাশি গ্লাইকোজেন ঘাটতিপূরণ করে। এক্ষেত্রে একটি সিদ্ধ ডিমে প্রায় ৬ গ্রাম প্রোটিন থাকে।
তিনি আরও বলেন, হালকা ওয়ার্কআউট এর পরে উচ্চমানের প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ সুষম খাবার গ্রহণ করুন এবং দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে শারীরিক ক্ষতিপূরণের জন্যে পর্যাপ্ত তরল পান করুন।
ব্যায়ামের পরে পেশীতে ব্যথা অনুভব করলে কী করবেন?
বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, কিছু ফলের রস যেমন তরমুজ ও চেরির রস ব্যায়ামের পরে পেশীর ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। ২০১০ সালে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব স্পোর্টস নিউট্রিশন জার্নালে প্রকাশিত একটি স্বল্প পরিসরের গবেষণার স্বার্থে, ৫৪ জন দৌড়বিদ ২৪ ঘণ্টায় মোটামুটি ২৬.৩ কিলোমিটার দৌড়েছিলেন। এদের মধ্যে কয়েকজনকে সাতদিন আগে থেকে প্রতিদিন ২ বার চেরি জুস এবং অন্যদের প্লাসবো পানীয় পানের নির্দেশ দেয়া হয়। গবেষকরা দেখতে পান যারা চেরি জুস পান করেছিলেন তারা প্লাসবো পান করা দলটির তুলনায় দৌড়ের পর কম ব্যথা অনুভব করেছিলেন।
সর্বোপরি ফিলিপস বলেন, একটি ওয়ার্কআউট রুটিনে রিহাইড্রেটের জন্যে পর্যাপ্ত তরল, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ও ধৈর্যশীল অনুশীলনের জন্য কার্বোহাইড্রেট এবং শারীরিক ক্ষতিপূরণের জন্যে প্রোটিন রাখা উচিত। আমি এমন খাবার পছন্দ করি, যাতে এই তিনটি দিকই পূরণ করা সম্ভব। যেমন তরল দুধ বা বেরিসহ দুধ ও দই থেকে তৈরি স্মুদি। তথ্যসূত্র: সিএনএন
অনুবাদ: খাদিজা জাহান তন্বী
টাইমস/এনজে/জিএস