ভারত সরকার গত আগস্টে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ করে এবং বাইরের বিশ্বের সাথে এই অঞ্চলের সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তবে এমন পরিস্থিতিতেও একজন তরুণ কাশ্মীরি শিল্পী তার কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে কাশ্মীরিদের কণ্ঠস্বরকে আরও জোরাল করে বিশ্বের সামনে তুলে ধরছেন।
নিউইয়র্কের কাশ্মীরি কার্টুনিস্ট মীর সুহেলের চিন্তা-চেতনা দখল করে আছে তার জন্মস্থান কাশ্মীর। এই হিমালয় অঞ্চলে প্রায় ১২ মিলিয়ন লোকের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দানকারী ৩৭০ ধারা বাতিলের ১ বছর হয়ে গেছে, যা ফুটে উঠেছে তার ব্যঙ্গচিত্রেও।
তিনি একটি কার্টুনে ফুটিয়ে তুলেছেন, একজন ভারতীয় সৈনিক একজন কাশ্মীরির পায়ে জাফরান রঙের গুলি চালিয়ে তাকে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের ৫ আগস্টের সিদ্ধান্তটি উদযাপন করতে বাধ্য করছে।
গত বছর সেনা মোতায়নের পর থেকেই কাশ্মীরের পর্যটন ও বাণিজ্য বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল, স্কুল ও কলেজের ক্লাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ওই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
৩১ বছর বয়সী কাশ্মীরি এই কার্টুনিস্ট গণমাধ্যমকে বলেন, “আগে কিছুটা আশা ছিল যে আমাদের কিছু একটা ইতিবাচক হতে পারে। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে কাশ্মীরিরা শোকের মাতম করে চলেছেন।”
এই অঞ্চলের অন্যান্য শিল্পীদের শিল্পকর্মের মতো, ভারতীয় শাসকদের ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিফলিত করে সুহেলের এইসব কার্টুন অনলাইনে প্রচুর প্রশংসা ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
কাগজে এবং ডিজিটাল মাধ্যমে উভয়ক্ষেত্রেই তার কাজে নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা কাশ্মীরিদের উপর অত্যাচারের চিত্র প্রতিফলিত হয়। তার কার্টুনে প্রায়শই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং অন্যান্য ভারতীয় গণমাধ্যমের ব্যক্তিত্বদের নিয়ে ও কাশ্মীরের ভারতপন্থী নেতৃত্বকে নিয়ে বিদ্রূপ ফুটে ওঠে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, তার বিভিন্ন কাজ কাশ্মীরি এবং ভারতীয় উভয় প্রচার মাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তবে তার কার্টুনগুলো কাশ্মীরিদের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের সমর্থকদের কঠোর সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে।
সুহেল বলেন, “লোকেরা আমার মা ও বোনকে অনলাইনে অপমান করে পোস্ট করছে এটি একটি নিত্যদিনের ঘটনা।”
সুহেলের সবচেয়ে সমালোচিত কার্টুনটি তিনি ভারতীয় মিডিয়াকে ব্যঙ্গ করে পোস্ট করেছিলেন। এটি গত জুলাইয়ে কাশ্মীরের সাপুর জেলায় এক ব্যক্তি তার নাতনীকে নিয়ে ভ্রমণে যাওয়ার সময় নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক তার খুন হওয়ার ঘটনাকে ফুটিয়ে তুলেছে।
এই হত্যার ঘটনায় জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা নিন্দা জ্ঞাপন করে বিবৃতি দিয়েছিল।
ভারত সরকারের সমর্থকরা তাকে প্রায়শই “পাকিস্তানি” এবং “ভুয়া মুসলিম সাংবাদিক” হিসেবে অভিযুক্ত করে। এদের রিপোর্টের কারণে গত ১২ মাসে তার বেশ কয়েকটি কার্টুন ইনস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষ সেন্সর করেছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমে কাজ করার সময় প্রায়শই তাকে তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ রাজনৈতিক কার্টুন নিয়ে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করতেন।
সুহেল জানান, গণমাধ্যমে কাশ্মীর সম্পর্কিত কার্টুনের কাজটি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং গত বছর ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই সক্রিয় ছিলেন।
অনেক কাশ্মীরির কাছে তার কাজ এই অঞ্চলের মানুষ প্রতিদিনের যে সমস্যার মুখোমুখি হয় তার সত্য উপস্থাপনা।
এ বিষয়ে কাশ্মীরি কবি এবং উত্তর কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রিলি অ্যাথার জিয়া বলেন, “মীর সুহেলের কাজ আপনাকে কাশ্মীরের নৃশংস সামরিক দখলের এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে।”
তিনি আরো বলেন, “সে কল্পনার জগৎ নিয়ে কাজ করে না। তার কাজে কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া প্রতি মুহূর্তের ঘটনা উঠে আসে, কাশ্মীরি দেহে যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে সেগুলি তার কাজের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর চোখে ধরা পড়ছে।”
তিনি বলেন, “এখন আমি প্রাতিষ্ঠানিক চাপ থেকে মুক্ত এবং স্বাধীনভাবে কাজ করছি। ফ্রিল্যান্সার হিসাবে কাজ করাই কার্টুনিস্টদের জন্য উপযুক্ত বলে মনে করি। নিউইয়র্কে আমি অনেক বেশি স্বাধীনতা পেয়েছি।”
তবে কাজের মাধ্যমে সুহেলের জনপ্রিয়তা বাড়ার অর্থ হচ্ছে তার শ্রীনগরে ফিরে যাওয়ার পথ ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় যে, ফেরার দরজাটি আমার জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে সেখানে থেকে কাশ্মীরি সাংবাদিকদের পক্ষে হিমালয় অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের মতামত প্রকাশ করা অত্যন্ত কঠিন।”
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েকমাসে কাশ্মীরে কমপক্ষে চার স্থানীয় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছিল এবং তাদেরকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, শ্রীনগরের একটি পরিবারে বেড়ে ওঠা সুহেল ওই অঞ্চলে কয়েক দশক ধরে চলমান সহিংসতা ও সামরিকীকরণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর থেকে সোহেল মোদী নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনা করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা।
টাইমস/এনজে