কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার জানালেন চাঞ্চল্যকর সংঘবদ্ধ ঘটনার আদ্যোপান্ত

পুলিশ মানেই ভয়ঙ্কর! পুলিশ মানেই আস্থাহীনতা! বাংলাদেশে পুলিশ মানেই যেন ঘুষের কারবার! সুযোগ পেলেই সবাই পুলিশকে একহাত নিয়ে নেন। কিন্তু কেউ কী একবারের জন্যও পুলিশকে কাছ থেকে বিবেচনা করেন? নাকি দুর থেকেই ছিঃ ছিঃ করেন?

জনগনের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের গুরু দায়িত্ব পালনে পুলিশ সদা তৎপর। এছাড়া অপরাধ দমন, অপরাধী শনাক্ত, গ্রেপ্তার ও মামলার তদন্তসহ নানা কাজে পুলিশই এখনো আস্থার প্রতীক। এখনো বিপদে পড়লে মানুষ পুলিশের কাছেই ছুটে যায়।

চাঞ্চল্যকর ঘটনার পরে একজন পুলিশ অফিসার ও পুলিশ বাহিনীর ওপর কতটা চাপ তৈরি হয় তা আমরা জানি না। গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরে পুলিশের তৎপরতা কেমন থাকে, সেটাও আমাদের অজানা। তাই সুযোগ পেলেই আমরা পুলিশকেই ধিক্কার দেই। কিন্তু আমাদের এখন থেকে ভাবা উচিত। পুলিশকে নিয়ে আমাদের আরও গভীরে চিন্তা করা উচিত। কেন গভীরে ভাবার কথা বলছি? চলুন কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম খানের ফেসবুক পোস্ট থেকে চাঞ্চল্যকর একটি সংঘবদ্ধ ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে আসি---

রাতটা ছিল আর কয়েকটা রাতের মতই। খাওয়া দাওয়া শেষে স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে প্রতিদিনের মতই রাত ১১ টার দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন রানা (ছদ্ম নাম) সাহেব। কিন্তু তিনি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেন নি কি বিপদ অপেক্ষা করছে তার পরিবারের জন্য।

ঘটনাটি ২৭ জুলাইয়ের। সকালে নাশতার টেবিলে বসে অভ্যাসমত অফিসিয়াল ফোনের মেসেজ চেক করছিলাম। রাতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় সকল থানায় ওয়ারলেসে নির্দেশনা দিয়েছিলাম যেন টহল দল তৎপর থাকে। নির্দেশনা অনুযায়ী কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশের গ্রুপে পাঠানো শেষ ছবিটি ছিল রাজারহাট থানার ওসির। রাজারহাট উপজেলার চায়নাবাজার চেকপোস্টে ডিউটি তদারকরি ছবি।

মেসেজে চোখ বুলাতে গিয়ে দেখলাম, রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়নের এক বাড়িতে গভীর রাতে তিনজন দরজা ভেঙ্গে ঢুকে গৃহকর্তাকে মারধর করেছে। এছাড়া একই বাড়ির কিশোরী মেয়েকে পাষন্ডরা ধর্ষণ করে রেখে গেছে পাশের বাগানে। বিষয়টি খুবই বেদনাদায়ক।

রাজারহাট থানার ওসির দেয়া ম্যাসেজটি পড়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কুড়িগ্রামে দায়িত্ব নিয়ে আসার পর এটাই সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর আগে এরকম ঘটনার মুখোমুখি হইনি। মেসেজ পড়া শেষ করেই এডিশনাল এসপি সার্কেল উৎপলকে ফোন করলাম। তিনি ঘটনাস্থলে আছেন বলে জানালেন। এছাড়া ঘটনাস্থলে সিআইডির ক্রাইম সিন সদস্যরাও পরিদর্শন করেছেন।

এডিশনাল এসপি উৎপলকে ঘটনার সবকিছু শুনে আপডেট জানাতে বললাম। বিষয়টি দ্রুত ডিআইজি স্যারকে জানালাম। মূল ঘটনা চুরির উদ্দেশ্যে নাকি কিশোরী মেয়েটিকে কেন্দ্র করে, এ নিয়ে শুরু হলো তদন্ত।

ওই দিন নাগেশ্বরী আর ফুলবাড়ীতে দুইটি পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রাম ছিল। প্রোগ্রাম শেষ করে রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়নে গেলাম।

গিয়ে দেখি, ভিকটিমের একতলা সেমি পাকা ঘর, বাড়ীর পেছনে আরেকজনের জমি। যেটা কাটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। অপরাধীরা এই কাটাতার কেঁটে এই বাড়িতে প্রবেশ করেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেল।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সরাসরি কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে চলে গেলাম চিকিৎসাধীন ভিকটিম বাবা ও মেয়েকে দেখতে। বাবার মাথায় মারাত্মক জখমের চিহ্ন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে কাউকে সন্দেহ করেন কীনা? তিনি উত্তর করলেন, না।

নজর করলাম কিশোরী মেয়েটির দিকে। এই অল্প বয়সে নিজের ওপর বয়ে যাওয়া পাশবিক নির্যাতনে মানসিকভাবে বিপর্যস্থ কিশোরীকে কি বলে শান্ত্বনা দেব জানা ছিল না। তারপরও তাকে মানসিক ভাবে শক্ত হতে সাহস যোগালাম। কিশোরী জানালো, তার মায়ের মোবাইলে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে প্রায়ই বিরক্ত করতো একটি ছেলে।

হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে বাসায় ফিরে বিকাল পাচটার পর দুপুরের খাবার খেয়ে অল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নিলাম। এরপর সন্ধ্যায় অন্যান্য অফিসারদের নিয়ে বসলাম। বৈঠকে সবার একটিই ভাবনা, যতদ্রুত সম্ভব রাজারহাটের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা।

ঘটনার পর দিনই র‌্যাব-১৩ এর সিও মহোদয় তার একটি টিমসহ চলে এলেন। তারাও ঘটনার রহস্য উদঘাটনে কাজ শুরু করলেন। ওই ঘটনার তদন্তের জন্য উলিপুর সার্কেলের এডিশনাল এসপি মাহমুদের নেতৃত্বে একটি টিম করে দিলাম। সেই সঙ্গে আধুনিক তদন্তের প্রথাগত সকল পদ্ধতি অনুসরণ করা শুরু করার নির্দেশ দিলাম।

কিন্তু তিনদিন গত হলেও কোনো কীনারা করা গেল না। এতে একটু হতাশও হলাম। এর মধ্যে এলাকার কিছু অতিউৎসাহী লোকজন দোষীদের গ্রেপ্তার দাবিতে মানববন্ধন করে বসলো। নেতা সাঁজার এই যে সিস্টেম এটা বেশ বিরক্তিকর। এধরণের মানববন্ধনের ফলে আমাদের কাজ ব্যাহত হয়। গতি হারিয়ে যায়।

তারপরও আমাদের টিম রাজারহাটের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে নানা কৌশল নিতে থাকলো। হঠাৎ সদর সার্কেলের এডিশনাল এসপি উৎপল আশার কথা শুনালো। তিনি জানালেন, ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন একজনের অবস্থান চিহ্নিত করা গেছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, ঘটনার পর দিন (মূলত ঘটনার পরের সকাল) ওই ব্যক্তি একটি মামলায় জামিন পেয়ে জেল থেকে বের হয়েছে। কাজেই নতুন করে দ্বিধায় পড়লাম। কারণ ঘটনার রাতে তো সে জেলে ছিল। তাহলে ঘটনার সাথে সে জড়িত হয় কীভাবে? কিন্তু হ্যা, এটাও সম্ভব। অনুসন্ধানে জানা গেল, যাকে ট্রেস করা হয়েছে তার স্ত্রীর সঙ্গে আসামিদের একজন সাক্ষাত করেছে।

এর পরে ঈদের আগের দিন খবর পাওয়া গেল সন্দেহভাজন এক আসামী বাসে করে ভূরুঙ্গামারী থেকে ঢাকা যাবে। এ খবর পাওয়ার পরে পুলিশের চারটা টিম মোতায়েন করে চেকপোস্ট বসানো হল। কিন্তু সারাদিনেও আসামিকে পাওয়া গেল না।

ঈদের দিন নামাজের পর এডিশনাল এসপি মাহমুদ ও উৎপল সারাদিন পড়ে থাকলো ভূরুঙ্গামারী। পুলিশ লাইনে অফিসিয়াল প্রোগ্রাম থাকলেও ওরা দুপুরের খাবার থানায় সেরে নিল।

এরপর হঠাৎ জানা গেল, আসামিদের একজন ঢাকার সাভারে অবস্থান করছে। আর বাকি দুইজন কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে। এমন পরিস্থিতিতে আসামিদের গ্রেপ্তার অভিযানের ছক তৈরি করলাম।

কিন্তু আমরা ছক তৈরি পর জানলাম আসামি নিজেই আবার ঢাকা থেকে লালমনিরহাটে ফিরে আসছে। এ খবর পেয়ে ভালোই লাগলো।

জানা গেল, ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারীর নাম কালাম। আর তার স্ত্রীর সঙ্গে অপর আসামি সালামের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। পরে ৮ আগষ্ট এক সাথে দুই টিম অভিযানে নামল। রাজারহাটে ঘটনাস্থলের কাছেই সালামের বাড়ি। তাকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হল। ভোরে আরেক অপরাধী কালাম গ্রেপ্তার হলো। তার বাড়ি লালমনিরহাট। আগে অটোরিক্সা চালাতো। এখন চুরিই তার পেশা।

পৃথক জিজ্ঞাসাবাদে নিজের দায় অস্বীকার করার পাশাপাশি অপরাধীরা একজন আরেকজনের ওপর দোষ চাপাতে লাগল। এটা অপরাধীদের একটা কমন কৌশল। কাজেই আমাদের বিড়ম্বনা বাড়লো।

তারপরও আমাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ থাকায় অপরাধীরা বেশি ঝামেলা করতে পারল না। দুই আসামিকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তারা সুর সুর করে সব স্বীকার করে নিল।

আসামিরা জানালো- মূলত চুরির উদ্দশ্যেই তারা ওই বাড়িতে হানা দেয়। ওই বাড়িতে ঢুকে মালামাল নেয়ার পর তারা কিশোরী মেয়েটির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। এসব কথা তারা স্বীকার করেছে।

ঘটনার পরেই ঢাকায় পালিয়ে যায় মূল পরিকল্পনাকারী কালাম। গ্রেপ্তারের পরে কালামকে দেখে রীতিমত আশাহত হলাম। ছোটখাট শীর্নকায় একটা মানুষ। গায়ে ময়লা শার্ট, দেখে ঘুনাক্ষরেও কেউ ধারনা করতে পারবেনা যে সে ধর্ষণের মত জঘন্য ঘটনা ঘটাতে পারে।

কালামকে দেখে মনে পড়লো গত বছরের রাজধানীর কুর্মিটোলা ঘটনার কথা। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী একই রকম একজন উদ্ভ্রান্ত লোকের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়।

সেদিন অনেকেই বিশ্বাস করেনি যে, মজনু ধর্ষণ করতে পারে। সবার ধারণা ধর্ষণ করতে হলে সুঠামদেহী ও সুদর্শন হতে হবে। কিন্তু আমাদের জানা উচিত, অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব বড় অদ্ভূত।

সব আসামিদের গ্রেপ্তারের পর ভিকটিম দুইজন তিন আসামীকে আদালতে শনাক্ত করেছেন। আসামি মালেক তার দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। কালাম ও সালামের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ৫টি ও ৩টি চুরির মামলা পাওয়া গিয়েছে রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে।

তারা পেশাদার অপরাধী। আদালতে তারাও দোষ স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। সে অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হবে।

এই মামলাটির রহস্য উদঘাটন আমাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। ঘটনাটি জেলাব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। সবচেয়ে বড় কথা কিশোরী মেয়েটিকে দেয়া কথা আমরা রাখতে পেরেছি।

 

টাইমস/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
৪২.৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পুড়ছে চুয়াডাঙ্গা Apr 27, 2024
img
আবারও কমলো স্বর্ণের দাম Apr 27, 2024
img
বরিশালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের ৩ জনের মৃত্যু Apr 27, 2024
img
মস্কো উৎসবে বিশেষ জুরি অ্যাওয়ার্ড জিতল বাংলাদেশি সিনেমা ‘নির্বাণ’ Apr 27, 2024
img
রোববার ৫ নির্দেশনায় খুলছে স্কুল-কলেজ, , বন্ধ থাকবে প্রাক-প্রাথমিক Apr 27, 2024
img
দুই বিভাগে বজ্রসহ বৃষ্টির আভাস দিলো আবহাওয়া অফিস Apr 27, 2024
img
গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছে ইসরায়েল : হামাস Apr 27, 2024
img
গাজা নীতির বিরোধিতা করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের পদত্যাগ Apr 27, 2024
img
বাগেরহাটে ট্রাক-ভ্যান মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিহত ৩ Apr 27, 2024
img
বিএনপি দাসত্ব করে ক্ষমতা পাওয়ার জন্য : ওবায়দুল কাদের Apr 27, 2024