বিদায় সায়মন ড্রিং, আমার প্রথম লিড স্টোরি!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরে জন্ম নেয়া সাংবাদিক সায়মন ড্রিং কি জানতেন বাকিটা জীবন রণাঙ্গনে যুদ্ধের খবর নিতে নিতেই কাটবে? হয়তো জানতেন, তাই সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৮ বছর বয়সেই। জীবদ্দশায় যাকে কাভার করতে হয়েছে ২২টি যুদ্ধ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব। যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আহতও হয়েছেন একাধিকবার। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নিধনযজ্ঞের খবর যিনি সবার আগে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের কাছে, সেই বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সায়মন ড্রিং মারা গেছেন গতকাল।

কোনো কোনো সময় আসে, যখন শব্দ-অক্ষর-সুর-বাক্য সব অর্থহীন হয়ে পড়ে। মানুষের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে ফেলে আসা অতীত। কারো কারো মৃত্যু, কেবল মৃত্যু নয়; মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁকে কেন্দ্র করে সেরা একটি স্মৃতি সমবায়। আজ তেমনিই একটি দিন। 

সায়মন ড্রিং কে? গুগল করলেই বিস্তারিত জানা যাবে। তার বহু পরিচয়ের একটি- তিনি একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো ব্রিটিশ সাংবাদিক। যার অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননায় ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার। তিনি বাংলাদেশে আসেন ১৯৯৭ সালে। দেশের প্রথম বেসরকারি টেরিস্ট্রিয়াল টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি গড়ার প্রধান কারিগর! একুশে টিভি দিয়ে সেদিন এক সায়মন ড্রিং সম্প্রচার সাংবাদিকতার ধারায় বিপ্লব করে বসলেন। বিটিভি’র একঘেয়েমি সরকারি প্রচারযন্ত্র থেকে মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নিলো। খুব দ্রুতই একুশে টেলিভিশন পৌঁছে গেলো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। সেই সায়মনকে সরকার পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটে!
 
মাওলানা রুমির মতে- দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি শান্তি পেতে চাইলে ‘অপরিচিত শহরে গিয়ে মুসাফির হয়ে যাও’। বিশ্বভ্রমণের নেশায় ১৯৬২ সালে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েন সায়মন ড্রিং। পড়ালেখা শেষে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ঘুরেটুরে ভারতে পা রাখলেন। ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে সায়মন ড্রিং ডেইলি টেলিগ্রাফের হয়ে কাজ করছিলেন কম্বোডিয়ায়। মার্চে লন্ডনের হেড অফিস থেকে তাকে চটজলদি বদলী করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ তথা বাংলাদেশে। কারণ ঢাকা তখন বিশ্ব রাজনীতির মনযোগে। ৬ই মার্চ ঢাকায় পা রেখে সংবাদ নাকে গন্ধ শুঁকে শুঁকে পরদিন ঠিকই হাজির হলেন রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সেই ভাষণও ছড়িয়ে দিলেন বিশ্বময়। 

সেই সাইমন ড্রিং আবার ২০১২ সালের মার্চে বাংলাদেশ আসেন। আজ থেকে নয় বছর আগের কথা। আমার মাথায় তখন পুরোদস্তুর সাংবাদিক হওয়ার প্রবল নেশা। সমকাল ও কালের কণ্ঠতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে ২০১১ সালের এরকম জুলাই মাসে চট্টগ্রাম ছেড়েছিলাম। ঢাকায় মোটামুটি বেকার-আকার-সাকার থেকে তিনমাস এটা-সেটরা করে কাটালাম। মাঝে জাগরণ (ক্যাম্প অফিস, প্রকাশিত হয়নি) ও বাংলাভিশন ঘুরে সমকালের ঢাকা অফিসে যোগ দিলাম মার্চ মাসে। সমকালের নেতৃত্বে তখন বাংলাদেশের কিংবদন্তী সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। চাকরিতে যোগদানের কিছুদিন পর সম্পাদক মহোদয় ত্রস্ত গলায় খানিকটা আত্মবিশ্বাসহীনতা রেখে বললেন, ‘ওকে দাও, ও পারবে।’ পাশে বসা নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি ভাই বললেন, ‘পারবে, রাজীব?’ বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেসব বিদেশি নাগরিক সমর্থন জানিয়ে নানা ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁদের সম্মাননা জানানো হচ্ছিলো। আমাকে বলা হলো একটি ফিচারাইজ স্টোরি করতে। শফি ভাই বললেন, সায়মন ড্রিং আর মার্ক টালিকে ফোকাস করবে। কারণ উনারা ছিলেন সাংবাদিক। আমি বললাম, ‘জ্বি ভাইয়া, অবশ্যই’! অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আমার ‘বদভ্যাস’। সেই বদভ্যাসে ভর করে রিপোর্ট লিখে যথাসময়ে জমা দিলাম। ছিলো রিপোর্ট, হয়ে গেলো ‘লিড স্টোরি’! সেদিন রাত সাড়ে ১১টায় সমকাল অফিস থেকে প্রথম শিফটের সবাই বেরিয়ে গেলেও আমি প্রেসের দাড়োয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। কিংবদন্তী সাংবাদিক গোলাম সারোয়ার ভাইয়ের শরীর ছিলো পুরোটাই সাংবাদিকতার মেজাজে মোড়ানো, কিন্তু হৃদয়ের অন্তস্থলে ছিলো ‘সিনেমা’। পত্রিকা হাতে নিয়ে মনটা একটু খারাপ। আমি শিরোনাম দিয়েছিলাম- ‘আজ ঋণ শোধের দিন’। কিন্তু সম্পাদক শিরোনাম বদলে দিয়ে করলেন- ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’!



রাত ১২টা বেজে গেলো। সমকাল প্রেসের দাঁড়োয়ানও বুঝলেন আমার আবেগ। প্রেসের একেবারে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি দেখতে পাচ্ছি আমার নামসহ ছাপা হওয়া ‘লিড স্টোরি’ দিয়ে পত্রিকা ভাঁজ হয়ে বেরুচ্ছে। জীবনে প্রথম কোন জাতীয় পত্রিকায় ব্যানার লিড! আমি তাকিয়ে আছি পত্রিকার ঘূর্ণনচক্রাকারে ছাপা মেশিনে।

পেছনে চট্টগ্রামকে ফেলে আমি ঢাকায় গেলাম। বাড়ি থেকে দূরে, অন্য কোথাও, ভিন্ন একটি পরিবেশ, নিঃসঙ্গতায় পেয়ে বসতো। যেন অনেকটা ভীড়ের মধ্যেও নির্জন আমি। তেজগাঁওয়ের সন্ধ্যার ঘোলাটে অভিমানে, খিলক্ষেতের সুউচ্চ ইমারতগুলোর মতো স্পর্ধায়, বিগত শীতের যাতনায় মহাখালির মতো তীব্র ধাবমান একটি শহরে আমি তখন সংবাদের খোঁজে পথহারা পথিক। এরপর বেশ কয়েকবার লিড পেলেও জীবনে প্রথম লিড স্টোরি পাওয়ার স্মৃতি আলাদা হয়েই থাকলো। ঢাকায় তিনবার মুখোমুখি হয়েছিলাম সায়মন ড্রিংয়ের। মুখে বিনয়, অঙ্গভঙ্গির স্মার্টনেস, ভাঙা বাংলা ও মুখের হাসি দিয়ে বলেছিলেন, "তুমি পারবে"। কতটুকু পেরেছি বা পারবো জানি না; সেদিন তাঁকে নিয়ে ব্যানার লিড পেয়েছিলাম, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ‘ছাপা না হওয়া সেই শিরোনাম’ দিয়েই নিবেদন জানালাম-
আজ ঋণ শোধের দিন
বিদায় সায়মন ড্রিং!


লেখক, রা‌জীব নন্দী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

Share this news on:

সর্বশেষ