বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধি

দেশের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে অজস্র অজানা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্মৃতি নিদর্শন। কোনোটা প্রকাশিত হচ্ছে, আর কোনোটা হচ্ছে না। সেই সব স্মৃতি নিদর্শনের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি লুকায়িত অনেক ঘটনা। তেমনি একটি নিদর্শন বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধি।

মোগল আমলের বহু স্মৃতি বিজড়িত এই সমাধিটির অবস্থান ময়মনসিংহের গৌরীপুর সদর উপজেলা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মাওহা ইউনিয়নের কুমড়ী গ্রামে। তবে গ্রামের লোকজন এ সমাধিক্ষেত্রকে মাজার হিসেবেই চেনে।

সমাধিস্থলে যেতে প্রথমেই চোখে পড়বে একটি গেটসম্বলিত সীমানাপ্রাচীর। প্রধান ফটকের সীমানাপ্রাচীরে পাথরখণ্ডে লেখা আছে বিবি সখিনার কাহিনি। ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে ইট-সিমেন্টে বাঁধানো সমাধি ও বাঁকানো অনেক গাছ। এর চারপাশে রয়েছে আকন্দ কুসুম ও কাঠগোলাপের গাছ। এই গাছের বয়স কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না। দূর থেকে দেখলে অপরূপ লাগে। সমাধিস্থলের পাশেই রয়েছে কয়েকটি চায়ের দোকান। কাহিনি অনুসারে কুমড়ী গ্রাম অনেকের কাছে ‘কেল্লা তাজপুর’ নামেও পরিচিত।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই কেল্লা তাজপুরের মোগল দেওয়ান উমর খাঁর কন্যা সখিনা ছিলেন অপরূপ সুন্দরী ও সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। এখান থেকে ৫০-৬০ মাইল দূরবর্তী বারভূঁইয়ার অন্যতম কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ির স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁর দৌহিত্র ফিরোজ খাঁর কানেও সে খবর পৌঁছে। সেই থেকে অপরূপ সুন্দরী সখিনাকে একপলক দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে ফিরোজ খাঁর অন্তর। কিন্তু দেওয়ান উমর খাঁ পরিবারের কঠোর পর্দাপ্রথা ফিরোজের ভালোবাসার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে কৌশলের আশ্রয় নেন ফিরোজ খাঁ। দরিয়া নামক এক সুন্দরী নারীকে তসবি বিক্রেতা সাজিয়ে উমর খাঁর অন্তঃপুরে সখিনার বাসগৃহে পাঠানো হয়। দরিয়ার মুখে ফিরোজ খাঁর অসামান্য রূপ-গুণের কথা শুনে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত সখিনা নিজের অজান্তেই মনপ্রাণ সঁপে দেয় ফিরোজের চরণতলে। ফিরোজ খাঁ জঙ্গলবাড়িতে এসে পরিবারের সম্মতি নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান উমর খাঁর দরবারে। কিন্তু কন্যাপক্ষ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। লজ্জা-ঘৃণা ক্ষোভে ফিরোজ খাঁ বিশাল বাহিনি নিয়ে কেল্লা তাজপুরে অভিযান চালান। অতর্কিত আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পরাজয় বরণ করে। শত্রুপক্ষের বিজয়ে উমর খাঁর অন্তঃপুর নারীশূন্য হলেও সখিনার ভাবান্তর হলো না। তিনি ঠায় বসে থাকলেন। বিজয়ী ফিরোজ অন্তঃপুরে ঢুকে তাকে বাহুবন্দি করেন।

এদিকে পরাজিত উমর খাঁ প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ফিরোজ খাঁকে বন্দি করেন। সখিনাকে তালাক দেয়ার জন্য তার ওপর চাপ দেন। কিন্তু ফিরোজ খাঁ তালাক দিতে রাজি হননি। এ সময় হঠাৎ যুদ্ধের ময়দানে হাজির হয় ১৭-১৮ বছর বয়সী এক যুবক। তাঁর হাতের ছটায় যেন বিদ্যুৎ লাফায়। ওই যুবকের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় ফিরোজের বিপর্যস্ত বাহিনী। দুর্ধর্ষ আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী বিপন্নপ্রায়। এ সময় কুমন্ত্রণা ছড়ায় যে ফিরোজ খাঁ সখিনাকে তালাক দিয়েছেন। টকবগে সেই যুবকের নিথর দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শিরোস্ত্রাণ খসে গিয়ে দেখা যায় তিনি আর কেউ নন, উমর খাঁর আদুরের দুলালী সখিনা! শোকে মুহ্যমান উমর খাঁ জামাতা ফিরোজ খাঁকে মুক্ত করে দেন। বন্দি থেকে মুক্ত হয়ে ফিরোজ পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন। এরপর কেল্লা তাজপুরবাসী দেখে প্রতিদিন সন্ধ্যায় এক দরবেশধারী ব্যক্তি সখিনার সমাধিতে প্রদীপ জ্বেলে নিশ্চুপ বসে থাকেন। দরবেশের বেশধারী ব্যক্তিটি আসলে সখিনার স্বামী ফিরোজ খাঁ। বীরাঙ্গনা নারী সখিনা যে জায়গায় প্রাণত্যাগ করেন, সেই কুমড়ী নামক স্থানেই গড়ে উঠেছে তাঁর সমাধি।

অতীতে কিল্লাতাজপুর গ্রামের চারপাশে প্রায় চার মাইলব্যাপী মাটির উঁচু প্রাচীর ছিল। সেখানে ঘোড়দৌড় হতো। গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে দুই মাইল বিস্তৃত সুরিয়া নদী। নদীর পাশেই রয়েছে যুদ্ধের পরিখার চিহ্ন। স্থানে স্থানে রয়েছে উঁচু মাটির টিলা। রয়েছে বীরাঙ্গনা সখিনার বাবা কেল্লা তাজপুরের দেওয়ান উমর খাঁর বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। প্রায় ২০ একর জমিতে অপূর্ব কারুকাজমণ্ডিত বাড়িটি নির্মিত হয়েছিল। গ্রামের মানুষ উমর খাঁর বাড়িকে রাজবাড়ি বলে থাকে। এর পেছনে ছিল হাতি রাখার স্থান, যা গ্রামের মানুষের কাছে পিলখানা হিসেবে পরিচিত। ছিলো তাল, মজা, ছিমু রানী, হাসি, মীরা ও কটুর দিঘি নামে বেশ কয়েকটি বিশাল পুকুর। এগুলোর বেশিরভাগই মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। এখনো কিল্লাতাজপুর গ্রামে মাটি খুঁড়লে পাওয়া যায় নানা কারুকার্যময় ইট। অনেক ইটে ফারসি অক্ষরের লেখাও দেখা যায়।

কিভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি গৌরীপুরে যাওয়া যায়। এছাড়া ঢাকা থেকে সড়ক পথে ময়মনসিংহে আসতে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে এনা, শামীম এন্টারপ্রাইজ, সৌখিনসহ কয়েকটি পরিবহন বাস রয়েছে। এনা ট্রান্সর্পোটে ভাড়া জনপ্রতি ২২০ টাকা। তাছাড়া সৌখিন পরবিহনে ১৫০ টাকা। ময়মনসিংহ এসে ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের কাছের বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস কিংবা সিএনজিযোগে গৌরীপুর আসতে পারেন। ময়মনসিংহ থেকে লোকাল বাসের ভাড়া ২৫ টাকা। গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ১০০-১৫০ টাকায় সিএনজি রিজার্ভ করে কুমড়ী গ্রামে যাওয়া যায়। এ ছাড়া গৌরীপুর থেকে ভুটিয়ারকোনা বাজারে টেম্পো বা ইজিবাইকে আসতে পারেন। ভাড়া ১০-১৫ টাকা। এরপর ১০ থেকে ১৫ টাকায় রিকশায় কুমড়ী গ্রামে।

অথবা ঢাকা থেকে ট্রেন করেও যেতে পারেন। ঢাকা থেকে তিস্তা এক্সপ্রেস (সকাল সাতটা বিশ), মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস (দুপুর দুইটা বিশ), যমুনা এক্সপ্রেস (বিকাল চারটা চল্লিশ), অগ্নিবীনা এক্সপ্রেস (সন্ধ্যা ছয়টা), হাওড় এক্সপ্রেস (রাত এগারোটা পনেরো) এ ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে ছাড়ে। ভাড়া শ্রেণিভেদে ১০০ থেকে ৩৬০ টাকা। সেখান থেকে ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের কাছের বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস কিংবা সিএনজিযোগে যাওয়া যাবে বিবি সখিনার সমাধিস্থলে।

কোথায় থাকবেন: থাকার জন্য আসতে হবে ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে রয়েছে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল। উল্লখেযোগ্য কয়েকটি হলো আমির ইন্টান্যাশনাল (০১৭১১১৬৭ ৯৪৮), হোটেল মুস্তাফিজ ইন্টারন্যাশলনাল (০১৭১৫১৩৩ ৫০৭), হোটেল হেরা (০১৭১১১৬৭ ৮৮০) হোটেল সিলভার ক্যাসল (০৯১৬৬১৫০, ০১৭১০৮৫৭ ০৫৪), হোটেল খাঁন ইন্টারন্যাশনাল (০৯১৬৫৯৯৫) প্রভৃতি।

খাওয়া দাওয়া: খাবারের জন্য গৌরীপুর শহরে পাবেন বেশ কিছু খাবার হোটেল। ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থল প্রেস ক্লাব ক্যান্টিনের মোরগ পোলাওয়ের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। এছাড়া হোটেল সারিন্দা ও হোটেল ধানসিঁড়িও ভালো । এছাড়াও শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে মাঝারি ও নিম্নমানের বেশ কিছু খাবার হোটেল।

Share this news on: