ফেসবুকে বন্ধুত্ব করে পার্সেল পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণাকারী চক্রকে গ্রেফতার

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েদের নামে ভুয়া আইডি খুলে ব্যবসায়ী বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের টার্গেট করত প্রতারক চক্রটি। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিলেই নিজেদের তারা বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিত। 

বন্ধুত্ব স্থাপনের পর দামী উপহার পাঠানোর লোভ দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিত সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রটি।


সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই চক্রের নয়জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব, যাদের সাতজনই বিদেশি।

মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।

তিনি জানান, মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত র‌্যাব-৪ এর একটি দল র‌্যাব-৮ এর সহযোগিতায় এ অভিযান চালায়। 

এ সময় তাদের কাছ থেকে আটটি পাসপোর্ট, ৩১ টি মোবাইল, তিনটি ল্যাপটপ, একটি চেক বই, তিনটি পেনড্রাইভ এবং নগদ ৯৫ হাজার ৮১৫ টাকা জব্দ করা হয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক টম্বিখনা গেবুজা, নাইজেরিয়ার উদেজে ওবিন্না রুবেন, ইফুনান্যা ভিভিয়ান নাউইকি, সানডে শেডেরাক ইজিম, চিনেদু মোসেস নাজি, কলিমস ইফেসিনাচি তালাইকে, চিদিম্মা ইবেলে ইভেলফোর এবং তাদের এ দেশিয় সহযোগী নাহিদুল ইসলাম ও সোনিয়া আক্তার।

র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক জানান,গ্রেপ্তরকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে অভিনব কায়দায় বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুকে নিজেদের পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিত। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির পর দামি উপহার বাংলাদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার জাল বিছায়। 

একপর্যায়ে বাংলাদেশের কাস্টমস্ অফিসার পরিচয়ে এক নারী ভুক্তভোগীকে ফোন করে বলে তার নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস চার্জ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বারে পরিশোধ করতে বলা হয়। যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে তাই কাস্টমস চার্জ একটু বেশি হয়েছে বলে তাদের বুঝানো হয়। 

সন্দেহবশত কোনো ভুক্তভোগী সরাসরি টাকা দিতে বা দেখা করতে চাইলে প্রতারকরা এসএমএসের মাধ্যমে জানায়, ওই মুহূর্তে তারা বিদেশে অবস্থান বা জরুরি মিটিংয়ে আছে।

ভিকটিম তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে প্রতারিত হতেন। 

মোজাম্মেল হক আরও জানান, প্রতারিত ব্যক্তি অর্থ পরিশোধ করার পর তার নামে প্রেরিত পার্সেলটি সংগ্রহ করার জন্য বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট অফিসে গিয়ে দেখে যে, তার নামে কোনো পার্সেল আসেনি। প্রতারিত ব্যক্তি পার্সেল পাঠানো বিদেশি বন্ধুর সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে আর পাওয়া যায় না। তখন তিনি বুঝতে পারেন, ভয়াবহ প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

প্রতারকরা ভিকটিমদের জানায়, নানা দ্রব্য বিদেশ থেকে আনতে নকল টিন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজ বানাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। কেউ কেউ টাকা না দিতে চাইলে তাদেরকে মামলার ভয়ভীতি দেখায়। একপর্যায়ে ভিকটিম তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে মামলার ভয়ে সংশ্লিষ্ট বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়।

এই প্রতারক চক্রটি নিজেদের কর্মকাণ্ডকে বিশ্বাসযোগ্য করতে ‘জনসেবামূলক কাজের ফিরিস্তি’ তুলে ধরত বলেও জানায় র‌্যাব। 


মোজাম্মেল হক বলেন, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর প্রতারকরা জানায়, তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে। কিন্তু তারা তা খরচ বা নিজেদের দেশে নিতে পারছে না। প্রতারকরা সেই ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা ভিকটিমের কাছে পাঠাতে চায় এবং বলে তোমার কাছে রেখে দিও পরবর্তীতে আমি নেব। চাকরিজীবিদের বলে তাদের দিয়ে জনসেবামূলক কাজে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে এবং এতে তারা একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন পাবেন। 

আর যারা ব্যবসায়ী তাদের বুঝায় তার ব্যবসায় অর্থ লগ্নি করবে এবং সে ৩৫-৪৫ শতাংশ হারে কমিশন পাবেন। 

র‌্যাব জানায়, আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের বিদেশী নাগরিকরা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে রাজধানীর পল্লবী, রুপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় ভাড়া বাসায় অবস্থান করে। পরে তারা গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করে।

সোনিয়া আক্তার ও নাহিদুল ইসলাম এই আন্তর্জাতিক চক্রের এ দেশীয় সহযোগী। মূলত তাদের মাধ্যমেই এই প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা ভিকটিম সংগ্রহ, বন্ধুত্ব স্থাপন, কাষ্টমস্ অফিসার পরিচয় এবং শেষে অর্থ সংগ্রহ করে আসছিল।

নাহিদুল ২০০৮ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০১০ সালে একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে কাজ শুরু করে। পরে রেস্টুরেন্ট ও একটি কল সেন্টারে কাজ করে। ২০১৭ সালে ফ্যাশন ডিজাইন বিষয়ে ডিপ্লোমা করে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় যায় এবং ২০২১ সালে দেশে ফিরে আসে। সোনিয়া আক্তার তার স্ত্রী।

সোনিয়া ২০০৬ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০৮ সালে একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত একটি এম্বাসিতে ২৫ হাজার টাকা বেতনে চুক্তিতে চাকুরি করে। 

২০০৯ সালে তার প্রথম বিয়ে হয়, স্বামী নেশাগ্রস্ত হওয়ায় ২০১৭ সালে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। 

২০১৮ সালের শেষের দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাইজেরিয়ান নাগরিক উদেজে ওবিন্নার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। 

পরিচয়ের মাধ্যমেই সে এ প্রতারক চক্রের সাথে জড়িয়ে পরে। এজন্য সে প্রতারণার ২৫ শতাংশ অর্থ পেত। 

সোনিয়া আক্তারের নামে দক্ষিণখানে একটি চারতলা বাড়ি এবং একটি প্রাইভেট কার রয়েছে। গত এক বছরে তারা ৩০-৩৫ জনের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে স্বীকার করেছে।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সালমান খানের বাড়িতে হামলায় অভিযুক্ত তরুণের আত্মহত্যা May 01, 2024
img
সারাক্ষণ এসিতে থাকলে যেসব সমস্যায় ভুগতে পারেন May 01, 2024
img
বিলাসিতা ছেড়ে শ্রমিকদের কল্যাণে নজর দিন, শিল্প মালিকদের প্রধানমন্ত্রী May 01, 2024
img
আজও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে May 01, 2024
img
আমরা চিকিৎসক সুরক্ষা আইন পাস করাব : স্বাস্থ্যমন্ত্রী May 01, 2024
img
সংসদ অধিবেশন শুরু হচ্ছে কাল May 01, 2024
img
শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক রেখে উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর May 01, 2024
img
ছয় অলরাউন্ডার নিয়ে বিশ্বকাপ দল ঘোষণা আফগানিস্তানের May 01, 2024
img
টানা তাপপ্রবাহ: অবশেষে ঢাকাসহ ৪ বিভাগে বৃষ্টির আভাস May 01, 2024
img
যতবার সরকারে এসেছি ততবার শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়েছি: প্রধানমন্ত্রী May 01, 2024