২০ হাজার টাকায় অস্ত্র ক্রয় ৩ লাখে বিক্রি, পাঁচ দিনেই লাইসেন্স

পাশের দেশ থেকে অবৈধপথে অস্ত্র চোরাচালান করে ভুয়া লাইসেন্স তৈরির মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করতো একটি চক্র। বিভিন্ন অংশ খুলে আলাদাভাবে আনতো তারা। ১০-২০ হাজারে অস্ত্র কিনে তা ভুয়া লাইসেন্সসহ দুই থেকে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করতো চক্রটি। পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই মাত্র পাঁচদিনে অস্ত্রের লাইসেন্স করে দিতো চক্রের সদস্যরা। অথচ নিয়ম অনুযায়ী- অস্ত্রের লাইসেন্সে পেতে সময় লাগে প্রায় এক বছর।

অবৈধ ও ভুয়া লাইসেন্সের অস্ত্র নিয়ে একাধিক ব্যক্তি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সিকিরিউটি গার্ড হিসাবে চাকরিও করছেন। এ চক্রের মূলহোতা মো. পলাশ শেখসহ (৩৮) ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। তারা হলেন- মো. মনোয়ার হোসেন (৩২), রশিদুল ইসলাম (৪০), নাজীম মোল্লা (৩৫), মারুফ হোসেন (২৪) ও মো. নাইমুল ইসলাম (২২)।

তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ওয়ান শুটার গান, সাতটি একনালা বন্দুক, দুটি পিস্তলের ম্যাগাজিন, আট রাউন্ড গুলি, ওয়ান শুটারের গুলি দুই রাউন্ড, একনলা বন্দুকের গুলি ৬৭ রাউন্ড, ০.২২ বোর রাইফেলের গুলি ৪০ রাউন্ড, ১১টি জাল লাইসেন্স ও ১৯টি বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার নামের সিল জব্দ করা হয়।

সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, চক্রটি অবৈধপথে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান করতো। পরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে অভিনব কৌশলে ভুয়া ও জাল লাইসেন্স তৈরি করতো। এর মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্র বিক্রির জন্য বেসরকারি বিভিন্ন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাসংক্রান্ত চাকরি দিতে আকৃষ্ট করে আগ্রহীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিতো। চক্রটির মূলহোতা গ্রেফতার পলাশ। চক্রের সদস্য চার থেকে পাঁচজন।

খন্দকার আল মঈন বলেন, পাশের দেশ থেকে রিভলবার, পিস্তল ও এক নলা বন্দুকসহ বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র অবৈধপথে দেশে নিয়ে আসে। পরে আগ্রহী চাকরিপ্রার্থীদের কাছে জাল লাইসেন্সসহ অবৈধ অস্ত্র বিক্রি করে ও চাকরি দিয়ে থাকে। এ চাকরি দেওয়ার জন্য জনপ্রতি দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত নেন তারা। অবৈধ অস্ত্র ও ভুয়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সিকিরিউটি গার্ড হিসেবে চাকরি করতেন। এছাড়া চক্রটি বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে চড়া দামে জাল লাইসেন্স তৈরি করে অবৈধ অস্ত্র বিক্রি করতো।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার পলাশ চক্রের মূলহোতা। তিনি ২০০৪ সালে স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। জীবিকার তাগিদে ২০১৩ সালে চাকরির জন্য ঢাকায় আসেন। পরে একটি স্বনামধন্য সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি শুরু করেন। চাকরিরত অবস্থায় ২০১৫ সালে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ভুয়া লাইসেন্সকৃত একটি অবৈধ বন্দুক কিনে বেসরকারি ব্যাংকে বেশি বেতনে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি শুরু করেন। পরে তিনি নিজেই অবৈধপথে অস্ত্র চোরাচালান ও বিক্রি শুরু করেন। পাশাপাশি চার থেকে পাঁচজনকে নিয়ে একটি দল গড়ে তোলেন।

তিনি বলেন, পলাশের নেতৃত্বে চক্রটি সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তার নামের সিল তৈরি করে জাল লাইসেন্স তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে অবৈধ অস্ত্র বিক্রি করতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বনামধন্য বেসরকারি সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুবাধে ওই প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব অবস্থান তৈরি হওয়ায় বিভিন্ন চাকরি প্রার্থীদের বেশি বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখাতেন। আগ্রহী চাকরি প্রার্থীদের কাছে অবৈধপথে আনা ভুয়া লাইসেন্সকৃত অস্ত্র ২-৩ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতেন। পলাশ গত ৫-৬ বছর ধরে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ চোরাচালানের মাধ্যমে এনে সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত ব্যক্তিদের অবৈধ অস্ত্র সরবরাহের পাশাপাশি বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করতেন।

গ্রেফতার মনোয়ার স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ২০১৪ সালে চাকরির জন্য ঢাকায় এসে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি শুরু করেন। চাকরির সুবাদে পলাশের সঙ্গে তার সুসর্ম্ক গড়ে উঠে। পলাশের সহযোগিতায় দুই লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি একটি ভুয়া লাইসেন্সকৃত অবৈধ একনলা বন্দুক সংগ্রহ করে একটি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি শুরু করেন। পরে পলাশ তাকে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচার জগতে প্রবেশ করান। পলাশের নির্দেশনায় মনোয়ার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করতেন। এছাড়া ভুয়া লাইসেন্স তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে অস্ত্র বিক্রি করতেন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, গ্রেফতার রশিদুল স্থানীয় একটি মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করেন। ২০১৯ সালে চাকরির জন্য তিনিও ঢাকায় আসেন। চাকরির সুবাদে পলাশের সঙ্গে তার সুসর্ম্পক গড়ে উঠে। পরে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি ভুয়া লাইসেন্সকৃত অবৈধ অস্ত্র কিনে বেশি বেতনে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে আগ্রহী চাকরি প্রার্থীদের পলাশের কাছে পাঠাতেন।

র‍্যাবের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রেফতার নাইমুল ইসলাম স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে করেন। ২০২০ সালে তিনি চাকরির সন্ধানে ঢাকায় আসেন। পরে পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে পলাশের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। লোভনীয় বেতনের প্রস্তাবে আকৃষ্ট হয়ে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে ভুয়া লাইসেন্সকৃত অস্ত্র কিনে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বেশি বেতনে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে আগ্রহী চাকরি প্রার্থীদের পলাশের কাছে পাঠাতেন।

গ্রেফতার নাজিম মোল্লা স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পযর্ন্ত পড়াশোনা করেছেন। ২০২২ সালে চাকরির জন্য ঢাকায় এসে এবং পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে তার পলাশের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। পরে তিনি আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে ভুয়া লাইসেন্সকৃত অবৈধ অস্ত্র কিনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নেন। বিভিন্ন আগ্রহী চাকরি প্রার্থীদের তিনি পলাশের কাছে পাঠাতেন। এছাড়া গ্রেফতার মারুফ স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ২০২৩ সালে চাকরির জন্য ঢাকায় আসেন। পরে তিনি পলাশের মাধ্যমে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে ভুয়া লাইসেন্সকৃত অস্ত্র কিনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি শুরু করেন।

Share this news on: