দাদাভাই নওরোজিঃ গ্র্যান্ড অল্ড ম্যান অব ইন্ডিয়া

দাদাভাই নওরোজি। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সারির একজন রাজনীতিবিদ। তিনি একাধারে একজন বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী ও সামাজিক নেতা। এশীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য। তাকে বলা হয় ‌‘গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান অব ইন্ডিয়া।’

এ.ও. হিউম এর পাশাপাশি দাদাভাই নওরোজিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কৃতিত্ব দেয়া হয়। তার লেখা বই ‘পভার্টি এন্ড আন-ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’ সর্বপ্রথম ভারতের সম্পদ ব্রিটেনে স্থানান্তর করার বিষয়টি সবার নজরে নিয়ে আসে।

তার স্মৃতির সম্মানে ২০১৪ সালে ব্রিটেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী নিক ক্লেগ ব্রিটেন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষে ‘দাদাভাই নওরোজি পুরষ্কার’ চালু করেন।

২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর তার ১০০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ডাক টিকিট উৎসর্গ করেছে ভারতের ডাক বিভাগ।

১৮২৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) গুজরাটি ভাষাভাষী একটি দরিদ্র পার্সি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নওরোজি। মাত্র চার বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। এতে তার পরিবার চরম টানাপোড়নে পড়ে যায়। তখন তার মা মানেকবাই একাই সংসারের হাল ধরেন। বলতে গেলে নওরোজির সফলতার পেছনে পুরো কৃতিত্ব তার মায়ের।


মাত্র ১১ বছর বয়সেই পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছিলেন দাদাভাই। ১৫ বছর বয়সেই তিনি বৃত্তি পান এবং এলফিনস্টোন ইন্সটিটিউট থেকে বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৮৫৫ সালে তিনি এই কলেজের গণিত ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। আর তিনিই হলেন কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যাপক।

ওই বছরই ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ভারতীয় কোম্পানি ‘কামা এন্ড কোং’ এর অংশীদার হয়ে ব্রিটেন যান। কিন্তু কোম্পানির অনৈতিক কাজের প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন এবং ১৮৫৯ সালে নিজ উদ্যোগে ‘নওরোজি এন্ড কোং’ নামে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।

ষাটের দশক থেকেই দাদাভাই ভারতের জনগণের কল্যাণে কাজ শুরু করেন। তিনি ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের কঠোর বিরোধিতা করেন। তার নির্দেশনায় ১৮৬৫ সালে ‘লন্ডন ইন্ডিয়ান সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার ফোরাম হিসেবে কাজ করে।

ব্রিটিশ জনগণের কাছে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে ১৮৬৭ সালে তিনি ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন যাকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পূর্বপুরুষ বলা হয়।

ভারতে ফিরে ১৮৭৪ সালে বারোদার দেওয়ান (প্রধানমন্ত্রী) নিযুক্ত হন। ১৮৮৫-৮৮ পর্যন্ত মুম্বাই আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৮৮৬ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত হন। পরে তিনি আবার ব্রিটেন চলে যান এবং ব্রিটিশ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৮৯২ সালে ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৮৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রিটেনের সংসদে ছিলেন। এসময় তিনি পার্লামেন্টে ভারতে ব্রিটিশ দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরেন, যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক মাইল ফলক।

১৯০৬ সালে তিনি পুনরায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯১৭ সালের ৩০ জুন ৯১ বছর বয়সে বোম্বেতে মারা যান গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান অব ইন্ডিয়া দাদাভাই নওরোজি।

ব্রিটিশ দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরতে তিনি ১৯০১ সালে ‘পভার্টি এন্ড আন-ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’ বই লিখেন।

এ বইয়ে তিনি ‘ড্রেইন থিওরি’ দিয়ে ব্যখ্যা করেন কিভাবে ব্রিটিশরা ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করছে। এ তত্ত্বে তিনি ৬টি উপাদান উল্লেখ করে প্রমাণ করেন ব্রিটিশরা বিভিন্ন কৌশলে ভারতের সম্পদ পাচার করে নিচ্ছে।

তিনি তার বিভিন্ন বক্তব্য ও লেখনীতে ভারতে ব্রিটিশ দুঃশাসনের যে চিত্র তুলে ধরেছিলেন তা ব্রিটিশ বিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছিল।

তাই গান্ধী, জিন্নাহ ও নেহরুর পাশাপাশি দাদাভাই নওরোজি ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অন্যতম পথপ্রদর্শক।

 

Share this news on:

সর্বশেষ