হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী: গণতন্ত্রের মানসপুত্র

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ব্রিটিশ ভারতের একজন তুখোড় রাজনীতিবিদ ও আইন প্রণেতা। তার হাত ধরেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত।

১৮৮২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১০ সালে সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক, ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান ও আইনে পুনরায় স্নাতক করেছেন। ১৯১৮ সালে গ্রে’স ইন হতে বার এট-ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯২১ সালে তিনি মুসলিম লীগের হয়ে বঙ্গীয় আইন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৪ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টিতে যোগ দেন এবং কলকাতার ডেপুটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাস মারা গেলে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে দ্বিজাতি-তত্ত্বের পক্ষে কাজ শুরু করেন। পরে ১৯৩৬ সালে তিনি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি’ নামে দল গঠন করেন। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমুদ্দীনের শ্রম ও পৌর সরবরাহ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ থেকে বিজয়ী হয়ে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ভারত কিংবা পাকিস্তান কারো সঙ্গে একীভূত না করে শুধু বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন তিনি। প্রথম দিকে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই প্রস্তাব সমর্থন করলেও দেশ ভাগের সময় তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।

তবে পূর্ব বাংলাকে ভারতের পরিবর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে একিভূত করতে তিনি সমর্থন দেন। দেশ ভাগের পর মুসলিম লীগের বৈষম্যমূলক আচরণে তিনি চরম মর্মাহত হন। ফলে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫৩ সালে খাজা নাজিমুদ্দীনকে হঠিয়ে মুহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী হন এবং সোহরাওয়ার্দী এ সরকারের আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ভাসানীও শেরে বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময়ও তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীকে উৎখাত করতে ১৯৫৬ সালে মুসলিম লীগ, আওয়ামীলীগ ও রিপালিকান পার্টি মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। এ সরকারের অধীনে তখন পাকিস্তানের ৫ম প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন সোহরাওয়ার্দী।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচনায় তার ব্যাপক ভূমিকা ছিল। এ সময় প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার নিয়ন্ত্রণে আস্থাভোটের আয়োজন করতে পার্লামেন্টের অধিবেশন দেয়ার জন্য তিনি আহবান জানান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা অধিবেশন দিতে অস্বীকার করায় ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করেন।

সোহরাওয়ার্দী ১৯৬০ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেন এবং লেবানন চলে যান। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর লেবাননের বৈরুতে অবস্থানকালে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে এ মহান নেতা মারা যান।

২০০৪ সালে বিবিসি’র শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালির তালিকায় তার অবস্থান ছিল ১৯ তম।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on: