থমথমে কাশ্মীর এখন গণকারাগার

৭০ বছর পর জম্মু–কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বা স্বায়ত্তশাসন বাতিল করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার এটাকে ‘ঐতিহাসিক ভুলকে’ সংশোধন হিসেবে বিশেষায়িত করেছে। বিরোধীপক্ষের দিক থেকে এই পদক্ষেপকে ভারতের অখণ্ডতা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দিতো সংবিধানের যে ৩৭০ অনুচ্ছেদ, তা বিলোপের দুইদিন পরও কাশ্মীর কার্যত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। রোববার সন্ধ্যা থেকেই রাজ্যের টেলিফোন, মোবাইল এবং ইন্টারনেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। আশঙ্কা করা হচ্ছিল স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়ার ফলে সেখানে বড় ধরনের বিক্ষোভ হতে পারে।

বিবিসির সাংবাদিক আমীর পীরজাদা কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে জানিয়েছেন, কাশ্মীর এখন ক্রোধে ফুটছে। তার মধ্যেও বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের আটকে রাখা হয়েছে। ভারতের অন্যান্য প্রান্তে থাকা কাশ্মীরিরা নিজেদের পরিবারের সাথেও যোগাযোগ রাখতে পারছেন না।

সোমবার ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিলুপ্তি ঘোষণার আগে থেকে সেখানে হাজার হাজার অতিরিক্ত সেনা সদস্য পাঠিয়েছে ভারত। রাস্তায় সর্বত্র হাজার হাজার সেনা, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী টহল দিচ্ছে। সকল রাস্তা বন্ধ। সবখানে জারি হয়েছে কারফিউ।

ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাশ্মীরের হোটেল, গেস্ট হাউস, ব্যক্তিগত ও সরকারি ভবন অস্থায়ী কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত চার শতাধিক রাজনীতিবিদ, সমর্থক ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কাশ্মীর উপত্যকা এখন গণকারাগারে রূপ নিয়েছে।  

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী,  সেন্টাওর, হরি নিবাসের মতো আবাসিক হোটেল ও অতিথিশালা, বন বিভাগের গেস্ট হাউস, প্রটোকল ভবন সরকারি কর্মকর্তারা ব্যবহার করবেন।  আর বেসরকারি ভবন ও কোয়ার্টারগুলোকে সম্পূরক কারাগার বানানো হয়েছে।

কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ ও মেহবুবা মুফতিকে হরি নিবাসের পৃথক কটেজে রাখা হয়েছে।

কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ডা. ফারুক আব্দুল্লাহ এবং ৯১ বছর বয়সী সৈয়দ আলি শাহ গিলানিকে ছাড়া তাদের দুজনের সমর্থকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মঙ্গলবার গণমাধ্যমের সামনে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন ফারুক আব্দুল্লাহ। ন্যাশনাল কনফারান্সের এই নেতা দাবি করেন, তাকে সরকার গৃহবন্দী করে রেখেছে। যদিও সরকার তা অস্বীকার করেছে।

শ্রীনগর থেকে নির্বাচিত লোকসভার সাবেক সাংসদ ফারুক আব্দুল্লাহ তার বাসার পেছনের গেইট থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।

তিনি বলেছেন, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের বিরুদ্ধে তাকে ভোটদানে বিরত রাখা হয়েছিল।

সাবেক এই মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা শাফকাত খান বলেছেন, ফারুক আব্দুল্লাহকে তার গুপকার বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এমনকি তাকে পর্যন্ত প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।

ফারুক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘মোদি সরকারের এই পদক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে সংবিধানের বিরুদ্ধে।’

আবেগপ্রবণ হয়ে ফারুক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘৩৭০ অনুচ্ছেদের জন্য প্রয়োজনে আমি গুলি খেতে রাজি। আমি জানি না, আমার ছেলে কোথায়। সরকার আমাকে গৃহবন্দী করে রেখেছে।’

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভার অধিবেশনে বলেছেন, ফারুক আব্দুল্লাহকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়নি।

মঙ্গলবার সকালে যখন ফারুক আব্দুল্লাহ তার বাসভবন থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমের সামনে কথা বলার চেষ্টা করেন তখন তাকে আটকানো হয়। এখানে পরিষ্কার যে, তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে।

সূত্র জানায়, মেহবুবা মুফতি গ্রেপ্তারি ভঙ্গ করার চেষ্টা করেছেন। তার পড়ার জন্য মাত্র দুই বা তিন সেট কাপড় রয়েছে। তার দুই মেয়ে পোশাক নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পুলিশ দেখা করতে দেয়নি। খুব কড়াকড়িভাবে তাকে আটক করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ওমর আব্দুল্লাহকে আটকে রাখা হয়েছে।

জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের ডিজিপি ডিলবাগ সিং বলেন, ‘প্রশাসনের নির্দেশে রাজনৈতিক নেতাদের গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে।’

সূত্র জানিয়েছে, রাজনৈতিক বন্দীরা সহজেই মুক্তি পাচ্ছেন না। তারা যাতে বক্তব্য দিয়ে কাশ্মীরের জনগণকে উস্কে না দিতে পারেন এবং উপত্যকার শান্তি নষ্ট না হয়- এই জন্যই তাদের আটকে রাখা হয়েছে।

সূত্র জানায়, কাশ্মীরে যাতে কোনো প্রতিবাদ, আন্দোলন না হয় তার জন্যই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

ইন্ডিয়া টুডে টিভিকে সরকারি এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে কাশ্মীরের জনগণদের সময় লাগবে। এই কারণেই সময় দরকার।’

লোকসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ‘আমরা ভোটের জন্য এই পদক্ষেপ নেয়নি। এটা দেশের কল্যাণের জন্য করা হয়েছে। কাশ্মীরের বাসিন্দাদের মঙ্গলের জন্য করা হয়েছে। আমরা জম্মু ও কাশ্মীরে নতুন আশা জাগানোর কল্পনা করছি।’

কাশ্মীরে কেন বিরোধ?

হিমালয় এলাকার একটি অঞ্চল কাশ্মীরের পুরোটাই নিজেদের দাবি করে আসছে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই। একসময় রাজার শাসন ছিল পৃথিবীর ভূস্বর্গখ্যাত জম্মু–কাশ্মীরে। ১৯৪৭ সালের ভারত উপমহাদেশ ভাগের পর এটি ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়। অঞ্চলটি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে। পরে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে অঞ্চলটি দুই ভাগে ভাগে করে নেয় দুটি দেশ। তবে ভারতের অংশে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।

কাশ্মীরে নতুন কিছু ঘটতে চলেছে, সেটার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল আগস্টের শুরু থেকেই। ১০ হাজার অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন, হিন্দু তীর্থযাত্রা বাতিল, বিদ্যালয় ও কলেজ বন্ধ, পর্যটকদের কাশ্মীরত্যাগ, টেলিফোন–ইন্টারনেট সেবা বন্ধ, আঞ্চলিক নেতাদের গৃহবন্দী করার মতো ঘটনা ঘটে। তখনই জল্পনা–কল্পনা শুরু হয়, ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের ৩৫এ ধারায় কাশ্মীরকে দেয়া বিশেষ মর্যাদা তাহলে কি রদ করতে যাচ্ছে ভারত? সেটাই দেখা গেল  সোমবার। ওই দিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেটাই করল নরেন্দ্র মোদি সরকার। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকলেও বিশেষ মর্যাদায় আলাদা পতাকা, আইন তৈরির স্বাধীনতার মতো বিষয়ে বিস্তর স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয় রাজ্যটিকে। কিন্তু এখন সব ক্ষমতা কেন্দ্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। বলতে গেলে সব ক্ষমতাই হারিয়েছে কাশ্মীরিরা।

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
মিথিলা হাতে উঠলো ভারতের ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার May 04, 2024
img
আট দফা কমার পর বাড়লো স্বর্ণের দাম May 04, 2024
img
মুসলিম উম্মাহর একাত্মতা ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী May 04, 2024
img
সুন্দরবনের গহীনে ভয়াবহ আগুন May 04, 2024
img
সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার May 04, 2024
img
আইপিএলে প্লে অফে ওঠার দৌড়ে এগিয়ে যারা May 04, 2024
img
শিডিউল বিপর্যয়ে ভোগান্তিতে যাত্রীরা, ৬ ট্রেনের যাত্রা বাতিল May 04, 2024
img
সরকার গণমাধ্যমের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতে কাজ করছে: প্রতিমন্ত্রী May 04, 2024
img
শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন বাড়াতে কাজ করছে সরকার : শিক্ষামন্ত্রী May 04, 2024
img
ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হামাস May 04, 2024