নগর অক্সিজেন ব্যাংক হতে পারে উলম্ব বাগান

আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা। ইট-পাথরের কঠিন পরিবেশ। তবুও যেন এই শহরে রয়েছে অদৃশ্য এক মায়ার বাঁধন, ভালোবাসা, আন্তরিকতা। পৃথিবীর হাজার শহরের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের মাঝেও হৃদয়ের একটুকুন ভালবাসা জড়িয়ে আছে ঢাকাকে কেন্দ্র করে। ঢাকা তার আদর মাখা কোলে আশ্রয় দিয়েছে কোটি মানুষকে। আর এই কোটি নাগরিকের ভিড়ে এই নগরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা মিলছে না সবুজ প্রকৃতির। তাই তো ধূলোবালি আর যানজটের শহরটিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে আমরা অফিস, বাসাসহ সব জায়গাতে খুঁজে ফিরি এক ফালি সবুজ। কিন্তু সবুজ পাই কোথায়? কারণ সবুজের জন্য ঢাকার বুকে প্রয়োজনীয় জমির বড়ই অভাব।

নগরবাসীর বুক জুড়ে স্বস্তির আবেশ নিয়ে আমরা বলছি, জমি ছোট, তাতে কি? দেয়াল তো বড়। আর এই কঠিন দেয়াল হয়ে উঠতে পারে গাঢ় সবুজ। যোগান দিতে পারে আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন। কিন্তু কীভাবে?

তাই জানাব আজ বাংলাদেশ টাইমসের পাঠকদের। আজ আপনাদের নিয়ে যাব ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং বা উলম্ব বাগানে। ঘরে-বাইরের দেয়াল, বাসার সম্মুখভাগে খোলা পরিসর, বারান্দা- এসব ছোট্ট জায়গায় বাগান সৃজনের একটি বিশেষ পদ্ধতি হলো ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং। যেখানে কয়েকটি ধাপ বা তলায় একটি গাছের ওপর আরেকটি গাছ লাগিয়ে একটি উলম্ব বাগান করা হয়। এক্ষেত্রে অল্প জায়গায় অধিক গাছ রোপণ করে দেয়ালটিকে সবুজ বা বর্ণিল রঙে সাজিয়ে তোলা যায়। নগরে ছাদ বাগান বা আঙিনায় বাগান করার সুযোগ কম থাকলে এবং অফিস বা আবাসনে নতুনত্বের আবহ আনতে আমরা ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং বেছে নিতে পারি।

                      ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডে বাড়ির দেয়ালে উলম্ব বাগান  


সবুজের পরশে ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং


আমাদের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের একটি অংশ আসে সবুজ বৃক্ষ হতে। গাছ তার খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উপজাত হিসেবে প্রতিদিন সূর্যালোকের উপস্থিতিতে হাজার ঘনফুট বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহ করছে। শুধু কি তাই, পরিবেশ দূষণে প্রধান উপাদান কার্বন-ডাই অক্সাইডও বাতাস হতে শুষে নিচ্ছে গাছ। নগর জীবনের প্রতিদিনের বিড়ম্বনায় যুক্ত হয়েছে শব্দ দূষণ, ধূলিকণা, চোখের ক্লান্তি আর কনক্রিট উপাদানের দৃশ্যপট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেখা পাওয়া দুষ্কর।

গাছের নরম পাতাগুলো সহজেই কম্পন হওয়ায় শব্দ তরঙ্গকে বাঁধা দেয় মেটাল বা কনক্রিটের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। ঢাকার বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বিশ্বের অধিকাংশ শহরের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। অসহায় নগরবাসীকে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং। গাছের শরীরে বা পাতার খসখসে অংশে কিংবা পত্ররন্ধে ধূলিকণা আটকে পড়ে প্রতিনিয়ত। রাস্তার পাশের গাছের পাতাতে নজর পড়লেই দেখা মেলে বাস্তবতার। তাছাড়া, গাড়ির কালো ধোঁয়াও শুষে নেয় সবুজ প্রকৃতি, তার দেহ জুড়ে জায়গা মেলে কার্বন পার্টিকেলের।

দৃষ্টিজুড়ে সবুজের আবহ দেখতে আমাদের গ্রামে ছুটে যেতে হয় নতুবা নোঙ্গর ফেলতে হয় কোনো রিসোর্টের বিলাসবহুল আবাসিকে। কিন্তু আমাদের এই ঢাকাকে সহজেই সবুজে রূপান্তরিত করতে পারি বা প্রাকৃতিক রঙের খেলায় মাতিয়ে তুলতে পারি চারদিকে নয়ন জুড়ানো আবহের ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং দিয়ে। হোক না দশতলা সুরম্য অট্টালিকা। অল্প খরচে, সহজ পরিচর্যায়, বহুবর্ষী সবুজ, রঙ্গিন আর বাহারি ফুলের গাছে আচ্ছাদিত হতে পারে আমাদের সুউচ্চ নির্মাণ ভবন।

বিজয় সরণিতে সামরিক জাদুঘরের দেয়ালে উলম্ব বাগানবিজয় সরণির সামরিক যাদুঘরের দেয়ালে উলম্ব বাগান

নতুন ভবন নির্মাণে প্লাম্বিং পাইপগুলো ঢেকে দিতে বেগ পেতে হচ্ছে? ইট গাঁথলে পরবর্তী ম্যানেজমেন্টে সমস্যা, অ্যালুমিনিয়ামের প্লেটে আবৃত করতে হচ্ছে পাইপগুলো। আমরা সহজেই ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং-এ আবৃত করতে পারি অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গাগুলো।

উলম্ব বাগানের নান্দনিকতা

‘অ্যামাজান উইদিন অ্যামাজান’-কাজেও অ্যামাজানে, কাজ থেকে পালাতেও অ্যামাজান, এই স্লোগানে একটি নিউজ এসেছিল মার্চ ২০১৮ তে বিশ্ব মিডিয়ায়। ‘দ্য স্ফিয়ার্স’ খ্যাত ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং-এর ভবনটি তৈরি হয়েছে কাজের চাপে হাঁপিয়ে উঠা কর্মীদের পালিয়ে একটু প্রকৃতির মাঝে জিরিয়ে আসবার জন্য। সিঙ্গাপুরের দৃশ্যপট শুধু নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বেঙ্গালুরুর ভ্যালিকন সিটি বা খোদ কলকাতায় বিভিন্ন জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং বা উলম্ব বাগান। আমাদের ঢাকায় অভিজাত এলাকাতে এমন বাগান নজরে পড়ে, পথচারীর দৃষ্টি আটকায়।

খরচ আর রক্ষণাবেক্ষণের চিন্তায় আমরা এড়িয়ে চলি ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং, আশ্রয় নেই নতুন কোনো চকচকে ইন্টেরিয়র সামগ্রি নতুবা কংক্রিট দেয়ালের। গাছ মানেই প্রতিদিন পানি দেয়া, মাটি-কাঁদায় চারপাশ নষ্ট করা, সপ্তাহান্তে সার-মাটি মেশানো, পোঁকা-মাকড় আর রোগ বালাই দমনে কীটনাশকের ব্যবহার, প্রুনিং, ট্রেনিং ও গাছ বদলের ঝামেলা। শহুরে ব্যস্ত জীবনে নতুন করে ব্যস্ততার ভয়ে অনেকেই বাগান করতে উৎসাহ পান না। অনেকে দেয়ালজুড়ে সবুজের আবহ সৃজনে আশ্রয় নেন আর্টিফিসিয়াল গাছ পাতার কিংবা প্লাস্টিক লন-ঘাসের।

আমরা শুরুতেই বলেছিলাম অল্প খরচে, সহজ পরিচর্যায়, বহুবর্ষী সবুজ বা রঙিন বাহারি ফুল বা পাতা গাছ দিয়ে ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং করার কথা। ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং ভেতর ও বাইরে করতে আমরা শেড-লাভিং এবং উজ্জ্বল সূর্যালোকের গাছ নির্বাচন করতে পারি। বিদেশি দামি গাছের পরিবর্তে দেশি ট্রপিক্যাল প্লান্ট আমাদের পরিচর্যা সহজ করবে।

তাছাড়া, খরা সহনশীল গাছ দিয়ে ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং করলে প্রতিদিন পানি দেবার প্রয়োজন পড়বে না, শীত মৌসুমে সপ্তাহান্তে দু-একবার পানি দিলেই গাছ বেঁচে যাবে।

প্রচলিত ধারণায়, ছোটাকৃতির গুল্মজাতীয়, মানিপ্লান্ট বা ফার্ন দিয়ে ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং না করে বহুবর্ষজীবী মাঝারি আকৃতির সবুজ, রঙিন অথবা প্রায় বছর জুড়ে ফুল ফোঁটে এমন গাছ নির্বাচন করে বাগানের সময়কাল দীর্ঘায়িত করতে পারি। এতে অবকাঠামো নির্মাণের খরচও কমে, অল্প গাছ আর রক্ষণাবেক্ষণে প্রাকৃতিক দেয়ালে আচ্ছাদিত হয়ে উঠে উলম্ব বাগান। দেশি প্রজাতির গাছসমূহ নতুনত্বের চমক সৃষ্টি করতে না পারলেও, দৈনন্দিন পরিচর্যায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন পড়ে না। আধুনিক ভার্টিক্যাল গার্ডেনিংয়ে আমরা মাটির পরিবর্তে জৈব উপাদানে গাছ লাগাই বলে কর্দমাক্ত হয় না এবং বাগানটি ওজনে হালকা হয়, ফলে দুর্ঘটনায় ক্ষতির সম্ভবনা কমে যায়।

                                      ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডে বাড়ির দেয়ালে উলম্ব বাগান

গাছ নির্বাচন


গাছ নির্বাচনে আমাদের প্রথম প্রশ্ন, কোথায় করছি ভার্টিকেল গার্ডেনিং- সূর্যালোকে না ছায়াযুক্ত স্থানে? সারাদিন কি রোদ পড়ে নাকি আংশিক রোদ পড়ে? বাতাসের প্রবেশ কেমন? শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আবদ্ধ কোনো স্থান? স্থাপত্যবিদ, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার বা ভোক্তার প্রাকৃতিক সবুজ বা অন্য কোনো বর্ণের কনট্রাস্ট চাহিদা অনুসারে বেছে নেব আমাদের উলম্ব বাগানের বৃক্ষরাজি।


সাধারণত উজ্জ্বল বর্ণের ফুল প্রখর সূর্যালোকের আলোতে ফুটে। আবার দিনের আলোয় গাছের পাতার রঙ ভিন্ন হয়। কম আলোতে হলুদ, সবুজাভাব হলুদ, লাল বা গাঢ় বর্ণসমূহে অনেকটা মলিন হয়ে উঠে। কিছু সবজি বা ফল আমরা ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং নিয়ন্ত্রিত পরিচর্যায় চাষ করতে পারি।

  • শেড লাভিং প্লান্ট (মাঝারি)
  • শেড লাভিং প্লান্ট (ছোট)
  • শেড লাভিং প্লান্ট (বর্ণিল)
  • ফুল প্রদানকারী গাছসমূহ
  • বিভিন্ন রঙের পাতাযুক্ত গাছ
  • সবুজ পাতার গাছ (মাঝারি)
  • সবুজ পাতার গাছ (ছোট)
  • বাগানবিলাস
  • এলোকেশিয়া
  • লিলি
  • অ্যান্থোরিয়াম
  • ফাইকাস
  • ড্রেসিনা
  • মিরিন্ডা
  • মনেস্টরা
  • বিভিন্ন পাম
  • আরালিয়া
  • পাতাবাহার
  • স্ন্যাক প্লান্ট
  • অগ্নিসর
  • কেয়া
  • ভেরিকেটেড ড্রেসিনা
  • ডাইফেনবেকিয়া
  • কম খরচের অবকাঠামো ও পরিচর্যা

ভিন্ন পদ্ধতিতে ইস্পাত, লোহা, প্লাস্টিক কাঠামো অথবা প্রাকৃতিক কাঠ বা বাঁশের ফ্রেমে ভার্টিক্যাল গার্ডেন করতে পারি। ফ্রেম দেয়ালে আটকিয়ে বা পোর্টেবল পদ্ধতিতে নির্মাণ করা যেতে পারে। তাছাড়া দেয়ালে স্থায়ীভাবে গাছের বেড বানানো যেতে পারে। এসব ফ্রেমে টব ঝুলিয়ে অথবা ছোট আধার তৈরি করে অগভীর মূলের গাছ লাগানো যায়। দেশীয় এ সকল উপাদান সহজেই কমখরচে জোগাড় করা যায়। অনেকে আমদানিকৃত উপকরণ দিয়ে ভার্টিক্যাল গার্ডেনের অবকাঠামো নির্মাণ করেন।

নিয়মিত পরিচর্যায় বাইরের বাগানে খরা মৌসুমে পরিমিত সেঁচের প্রয়োজন পড়ে। অতিরিক্ত জমাট পানি গাছ নষ্ট করে ফেলে। প্রয়োজনীয় সময়ে কয়েক মাস অন্তর পুষ্টি উপাদান যোগ করতে হয়। তাছাড়া অটোমেটিক ড্রপ ইরিগেশনে ও নিষ্কাষণ ব্যবস্থাপনাতে আমরা প্রতিনিয়ত হাতের ছোঁয়া ব্যতীত সেচ ব্যবস্থাপনা করতে পারি। সাধারণত বর্ষাকালে বা তাপমাত্রা বেশি থাকলে ছত্রাকজাতীয় রোগের প্রকোপ দেখা যায়। সেক্ষেত্রে পরামর্শ অনুযায়ী ছত্রাকনাশক বা অন্য কোনো কীটনাশক ব্যবহার করতে পারি।

 

লেখক- কাজী মো. আবু সাঈদ, উপ-বিভাগীয় কর্মকর্তা, আরবরিকালচার গণপূর্ত উপ-বিভাগ, জাতীয় সংসদ ভবন।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিএনপি দাসত্ব করে ক্ষমতা পাওয়ার জন্য : ওবায়দুল কাদের Apr 27, 2024
img
আজ ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না রাজধানীর যেসব এলাকায় Apr 27, 2024
img
গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা শুরু আজ, কেন্দ্রে থাকবে পানি ও চিকিৎসা ব্যবস্থা Apr 27, 2024
img
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধা Apr 27, 2024
img
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ Apr 27, 2024
img
আ.লীগ নেতাকর্মীদের দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর Apr 26, 2024
img
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ চুয়েট, খোলা থাকবে হল Apr 26, 2024
img
প্রথমবার এশিয়া কাপে আম্পায়ারিং করবেন বাংলাদেশের জেসি Apr 26, 2024
img
গাজায় ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে লাগতে পারে ১৪ বছর : জাতিসংঘ Apr 26, 2024
img
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী Apr 26, 2024