সাগর না হয়েও বিখ্যাত ‘নীলসাগর’

নীলসাগর! নামটি শুনলে মনে হয় অনেক বড় কোন সাগর বা মহাসাগর। কিন্তু নীলসাগর কোন সাগর বা মহাসাগর নয়। এটি নীলফামারী জেলার বিখ্যাত একটি দীঘির নাম। এটি জেলার একটি প্রাচীন ঐতিহ্য।

নানান প্রজাতির বৃক্ষরাজিতে ঘেরা দীঘিটির অবস্থান জেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাংগা মোজায়। দীঘিটি ৫৩.৯০ একর জমির উপর অবস্থান করছে। যার জলভাগ ৩২.৭০ একর এবং চারদিকের পাড়ের জমির পরিমাণ ২১ একর। পানির গভীরতা মাঝে ২৩ ফুট (জুন-অক্টোবর),পাড় ঘেষে ০৪ ফুট।

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর কোন এক সময়ে এ জলাশয়টির খননকাজ শুরু হয়েছিল। নীলসাগর বিরাট দীঘি, বিল্টা দীঘি ও বিন্না দীঘি নামেও পরিচিত।

জনশ্রুতি আছে যে, বৈদিক রাজা বিরাট এর ছিল বিশাল গরুর পাল। আর এই সব গরুর জন্য প্রয়োজন হতো প্রচুর পানির। বিশাল গরুর পালের পানির সংস্থান করার জন্যই রাজা পুকুরটি খনন করেছিলেন। পরে তার কন্যা বিন্নাবতীর নামে এর নামকরণ করেন বিন্না দীঘি।

অন্যদিকে হিন্দুশাস্ত্র মতে, খ্রিস্টপূর্ব নবম হতে অষ্টম শতাব্দীতে পান্ডবরা কৌরবদের চক্রান্তের শিকার হয়ে ১২ বছরের বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হন এবং মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের রাজধানীর এ স্থানটিতে ছদ্মবেশে বসবাস শুরু করেন। মনে করা হয়, সেসময় নির্বাসিত পাণ্ডবদের তৃষ্ণা মেটাতে বৈদিক রাজা বিরাট এ দীঘিটি খনন করেছিলেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে নীলফামারীর তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক এম.এ জব্বার দীঘিটি রক্ষণাবেক্ষণ ও মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি এখানে একটি গেট, মসজিদ, রেস্ট হাউজ নির্মাণসহ প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করেন। সে সময় থেকে দীঘিটি নীলসাগর নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।

দীঘিটি মূলত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত। এর পাড়ে রয়েছে আকাশমণি, মেহগনি, নারকেল, বনবাবুল, শিশুসহ অজানা-অচেনা নানান প্রজাতির ফুল ও ফলের সারি সারি বৃক্ষরাজি। চিত্ত বিনোদনের জন্য রয়েছে ঘোড়ার গাড়ী, নাগরদোলা, স্লিপার, দোলনা ইত্যাদি।

প্রতি বছর শীত মৌসুমে অসংখ্য অতিথি পাখির আগমনে মুখোরিত হয়ে উঠে নীলসাগর। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মার্গেঞ্জার, মাছরাঙা, ভুবনচিল, রাজহাঁস, সবুজ চান্দি ফুটকি, বাচাল নীল ফুটকি ইত্যাদি। তাছাড়া দিগিটির পাশেই আছেএকটি পার্ক। ১৯৯৮ সালে এ এলাকাকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়।

ভূমি মন্ত্রণালয় ১৯৯৮ হতে ২০০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘নীলসাগর দীঘি উন্নয়ন ও পাখির অভয়ারণ্য’নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। দীঘিকে আকর্ষণীয় ও নিরাপদ পর্যটন স্পট হিসাবে গড়ে তোলা, অতিথি পাখির অভয়ারণ্য বানানো, পাড়ে দেশী ও বিরল প্রজাতির বিভিন্ন বৃক্ষ রোপণ ও সংরক্ষণ করা, চিত্তবিনোদন ও অবকাশ যাপনের স্থান হিসাবে গড়ে তোলা এবং মাছ চাষের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করাই ছিল প্রকল্পের উদ্দেশ্য। ১৯৯৮ সালে এ এলাকাকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। এখানে প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সনাতন (হিন্দু) সম্প্রদায় বারুণী স্নান উৎসবের আয়োজন করে থাকে।

দীঘিটি পরিদর্শন করতে প্রতিদিনই অসংখ্য দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। কর্তৃপক্ষ দীঘিটির উন্নয়ন ও পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় করার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।

দীঘিতে প্রবেশ ফি দর্শনার্থী-১০ টাকা, বাইসাইকেল-১০ টাকা, মোটর সাইকেল-৫০টাকা /মাইক্রো/জীপ- ১০০টাকা, মিনিবাস/বাস-২০০ টাকা- এবং মৎস্য এ্যাংলিং-১,৫০০ টাকা।

কিভাবে যাবেন: সড়ক পথে ঢাকা থেকে নীলফামারির দূরত্ব ৩৯৬ কিলোমিটার। বাসে করে যেতে পারেন নীলফামারী পর্যন্ত। ঢাকা থেকে নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনে করেও যেতে পারেন। যারা আরেকটু আরামে যেতে চান, তারা আকাশ পথে সৈয়দপুর, সেখান থেকে বাস বা সিএনজি যোগে নীলফামারী। নীলফামারী থেকে ইজিবাইক/ রিক্সা/ ব্যানে করে যেতে পারেন নীলসাগর।

কোথায় থাকবেন: থাকার জন্য নীলফামারী শহরে রয়েছে আবাসিক হোটেল। পছন্দমত যেকোন একটি বেছে নিতে পারেন। রেস্ট হাউসসেও থাকতে পারবেন। ভাড়া ১০০০ টাকা (ভিআইপি), ৮০০ টাকা (সাধারণ)।

খাওয়া: শহরে রয়েছে বিভিন্ন মানের খাবার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের লক্ষ্য জানালেন সাকিব Apr 25, 2024
img
গাজায় ২০ জনকে জীবন্ত কবর দেয়ার অভিযোগ Apr 25, 2024
img
দীর্ঘ তাপপ্রবাহে রেকর্ড, কতদিন থাকবে জানাল অধিদপ্তর Apr 25, 2024
img
শিক্ষক নিয়োগ: পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে হাতে পৌঁছে যেত উত্তরপত্র Apr 25, 2024
img
বাংলাদেশের উন্নয়নের দিকে তাকালে আমরা লজ্জা পাই: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী Apr 25, 2024
img
রবিবার খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবারও চলবে ক্লাস Apr 25, 2024
img
এক দিনের ব্যবধানে আরও কমলো স্বর্ণের দাম Apr 25, 2024
img
চুয়েট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ Apr 25, 2024
img
যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া বিএনপি: কাদের Apr 25, 2024
img
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত শনিবার: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী Apr 25, 2024