বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন জোটের ‘প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর)’ ভিত্তিক সংসদ নির্বাচনের দাবি। এই দাবির যৌক্তিকতা, কার্যকারিতা ও এর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান। সম্প্রতি নিজের ইউটিউব চ্যানেল জাহেদস টেইক-এ এসে এ প্রসঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতির পক্ষে জামায়াতের বর্তমান কর্মসূচি তাদের কিছু স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে।
বিশেষত আলোচনায় আসা এবং মিডিয়ায় জায়গা করে নেওয়া। তবে এই দাবিকে কেন্দ্র করে তারা অতিরিক্ত প্রচার ও আগ্রাসী অবস্থান নিয়ে ফেলছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি, যা শেষ পর্যন্ত দলটির জন্য রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
তিনি বলেন, পিআর দাবির মাধ্যমে জামায়াত আপাতত আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে। দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের টক শো, ইউটিউব আলোচনা, অনলাইন পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন ‘পিআর’ শব্দটি ঘুরছে।
এতে তাদের মিডিয়া কাভারেজ বেড়েছে। জামায়াত এই ইস্যুকে বিএনপির ওপর চাপ তৈরির কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করছে। তারা চাইছে বিএনপি যেন জামায়াতকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক সমীকরণে রাখে।
জাহেদ উর রহমান প্রশ্ন তুলেছেন, জামায়াত যেসব যুক্তিতে পিআর দাবি করছে, সেগুলোর বাস্তবতা কতটুকু? তাদের মতে, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে মনোনয়ন বাণিজ্য কমবে, পেশিশক্তির ব্যবহার কমবে এবং নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে। কিন্তু বাস্তবে এটি আরো বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
তিনি বলেন, পিআর হলে পুরো মনোনয়ন নির্ভর করবে দলের কেন্দ্রীয় তালিকার ওপর। যেখানে জনগণের চাপ বা জনপ্রিয়তা বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ কমে যায়। এতে কেন্দ্রীয়ভাবে মনোনয়ন বাণিজ্যের সুযোগ বরং আরো বাড়তে পারে। উপরন্তু প্রতিটি দলে তখন তালিকায় নাম তোলার জন্য অভ্যন্তরীণ দৌড়ঝাঁপ, ক্ষমতার খেলা ও অস্বচ্ছতা আরো বাড়বে বলে তার আশঙ্কা।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক দলগুলো নিজের মার্কা ও ভোট ধরে রাখতে চেষ্টার কোনো ঘাটতি রাখবে না। সে ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মাঠের সংঘাত বা পেশিশক্তির ব্যবহার কমবে, এই ধারণা শিশুসুলভ যুক্তি।
তিনি বলেন, পিআর মানেই সবাই ভদ্র হয়ে যাবে, এমন ভাবাটা অবাস্তব। ভোট তো শেষ পর্যন্ত চাই-ই চাই, আর সে জন্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। জামায়াত নিজেদের দাবি নিয়ে এতটাই সরব হয়ে উঠেছে যে এখন যদি পিআর বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে সেটা তাদের জন্য একটি রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে দেখা দেবে। এটি তখন তাদের জন্য ইগোর ইস্যু হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর যদি তারা পরে নির্বাচন বর্জনের মতো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেটি ভবিষ্যতের রাজনীতিতে দলটির অবস্থানকে আরো দুর্বল করে দিতে পারে।
বিশেষ করে যখন নির্বাচনের আর মাত্র চার মাস বাকি, তখন এমন দাবিকে কেন্দ্র করে নির্বাচন থেকে সরে আসা রাজনৈতিক আত্মঘাত হয়ে উঠতে পারে। এ ছাড়া জামায়াত বলছে, দেশের ৭১% মানুষ নাকি পিআর পদ্ধতির পক্ষে। কিন্তু এর কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র দেখাতে পারেনি তারা। এমনকি গণভোট চেয়ে যে দাবিও তারা তুলেছে, সেটাও এখনো বাস্তবধর্মী কোনো পরিকল্পনায় রূপ নেয়নি।
জাহেদ উর রহমান বলেন, এখনো সময় আছে জামায়াত চাইলে দাবিটি রাজনৈতিকভাবে উপস্থাপন করে বাস্তবতার ভিত্তিতে কিছুটা পিছিয়ে এসে মুখ রক্ষা করতে পারে। কিন্তু যদি তারা আরেকটু বেশি এগিয়ে যায়, তাহলে নিজেই নিজের জন্য অসুবিধার পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলবে। একটা পর্যায়ে বিষয়টি এমন হয়ে যায় যে আর থামা যায় না। তখন সেটা রাজনৈতিক বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। জামায়াত সেই দিকেই এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
কেএন/টিএ