আসুন ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানি...

চীনের কেন্দ্রীয় উহান শহরে ২০১৯ সালের শেষ দিকে সনাক্ত হওয়া নতুন ভাইরাসটি মহামারীর কারণ হয়ে দাঁড়াবার ফলে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরী অবস্থা জারী করা হয়েছে। এর জন্য দায়ী বিশেষ এই করোনাভাইরাসটির নাম ২০১৯-এনসিওভি। প্রাদুর্ভাবের প্রথম দু'মাসে নতুন এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার সংখ্যা ২০০২-২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় নয় মাসে যত লোক মারা গিয়েছিল সে সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে।

এই ভাইরাসটি এতো ভয়ানক কেন?
একে ‌‘ছদ্মবেশী’ ভাইরাস হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। কারণ, সংক্রামিত লোকের একটি বড় অংশ তাদের প্রতিদিনের কাজকর্ম সম্পাদনের বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণে সক্ষম এবং এটি অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ২%, যা সার্সের ৯.৫% হারের তুলনায় কম। তবে এই সংখ্যা প্রাদুর্ভাবের প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ভরযোগ্য নয়। এমনকি একজন আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের অজান্তেই কয়েক লাখ মানুষের দেহে এটি ছড়িয়ে দিতে পারে। ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় অনুমান করা হয় যে সব ক্ষেত্র মিলিয়ে এই মৃত্যুর হার ১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ভাইরাসটি আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হওয়া ঘটনা বেড়েছে।

ভাইরাসটি কী করে?
ভাইরাসজনিত এই রোগটির নাম দেয়া হয়েছে ‘কোভিড-১৯’। সংক্রমণ হলে শিশু, কৈশোর ও অল্প বয়স্কদের মধ্যে হালকা অসুস্থতা দেখা দেয় এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে আরও গুরুতর রোগ দেখা যায়।

প্রাথমিক লক্ষণগুলি হলো- জ্বর, শুকনো কাশি ও ক্লান্তি। তবে হাঁচি ও সর্দি এই রোগের লক্ষণ নয়। গুরুতর ক্ষেত্রে ভাইরাসটি নিম্ন শ্বাসনতন্ত্রের কোষগুলিতে আক্রমণ করে এবং ফুসফুসে চলে যায়, ফলে শ্বাস নিতে অসুবিধা হয় এবং নিউমোনিয়ায় জনিত লক্ষণ ও প্রদাহ দেখা দেয়। প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি চতুর্থাংশেরও বেশি রোগীরা শ্বাসযন্ত্রের তীব্র জটিলতায় ভুগেছেন এই রোগে মারা গেছেন এমন অনেকের হৃদরোগের মতো অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল।

অন্য প্রকোপগুলির সঙ্গে কীভাবে তুলনা করা যেতে পারে?
‘কোভিড-১৯’ করোনাভাইরাসটি জিনগতভাবে সার্স ভাইরাসের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে এই ভাইরাসটির ক্ষেত্রে অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার কিছুটা কম। আরেকটি সাদৃশ্যপূর্ণ ভাইরাস মার্স-কোভ, যা ২০১২ সাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল, ওই সময় দু’হাজার ৪৯৯ জন আক্রান্তের মধ্যে ৩৪% মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্যদিকে, ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে আনুমানিক পাঁচ কোটি লোক মারা গিয়েছিল। ওই ঘটনায় মৃত্যু হার ৫% এরও কম ছিল, তবে বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ তখন সংক্রামিত হয়েছিল।

লোকেরা কীভাবে এটি ছড়িয়ে পড়ে?
সংক্রামিত ব্যক্তি যখন শ্বাস নেয়, কথা বলে, কাশি বা হাঁচি দেয়, তখন ভাইরাস কণা সুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এছাড়াও হাতসহ অন্য অঙ্গের মাধ্যমেও সরাসরি অন্য কারও কাছে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এয়ারোসোল নামে পরিচিত ক্ষুদ্র কণায় ভাইরাসটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এটি কতটা সংক্রামক?
মহামারী বিশেষজ্ঞরা সংক্রামিত ব্যক্তি এবং অতিরিক্ত সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা নির্ধারণ করে সংক্রামকতা দূর করার চেষ্টা করেন। এই পরিমাপ, যাকে বেসিক প্রজনন সংখ্যা বলা হয়, একটি মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কঠিন এটি তার সূচক। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে ২০১৯-এনসিওভির প্রাথমিক পরিসর ১.৪ থেকে ২.৫। এটি সার্সের সমান এবং ফ্লুর চেয়ে বেশি সংক্রামক। বেইজিংয়ের চিনা একাডেমি অফ সায়েন্সেসের একটি দলের অনুমান অনুযায়ী এই সংখ্যাটি ৪.০৮।

করোনাভাইরাস কী?
করোনাভাইরাস নামটি মূলত এর মুকুট-জাতীয় আকৃতির জন্য দেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস কোনো একটি ভাইরাস নয়, বরং একটি ভাইরাস গোষ্ঠী। সর্দি থেকে মার্স পর্যন্ত বিভিন্ন রোগের জন্য এসব ভাইরাস দায়ী।

কোথা থেকে এসেছে?
ডিসেম্বরের শুরুতে চীনের হুবাই প্রদেশের রাজধানী শিল্প নগরী উহানে ভাইরাসটির উদ্ভব হয়েছিল। প্রথম দিকে ধারণা করা হয়েছিল উহানের সামুদ্রিক বাজারের থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে, যেখানে জীবিত প্রাণী বিক্রি হয়। তবে প্রথম আক্রান্ত ৪১ জনের মদ্যে মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশের সঙ্গে বাজারটির কোনো যোগসূত্র নেই বলে জানা গেছে। তবে এটি প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রামিত রোগ, যা ‘জুনোস’ হিসেবে পরিচিত।

একটি নতুন ভাইরাস কতটা উদ্বেগ জনক?
মানুষের মধ্যে যখন একটি নতুন প্যাথোজেন উদ্ভূত হয় তখন সর্বদা উদ্বেগ থাকে কারণ তাদের দেহে সাধারণত এটির প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকে না এবং সাধারণত সেখানে নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা ভ্যাকসিন পাওয়া যায় না। নোভেল করোনাভাইরাস যেহেতু আগে মানুষের মধ্যে দেখা যায়নি, তাই এটি নিয়ে বিশেষ উদ্বেগের কারণ। ইতিমধ্যে ভাইরাসটি হাজার হাজার মানুষকে অসুস্থ করে তুলেছে। মনে রাখতে হবে, সার্স ভাইরাস দক্ষিণ চীন থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কতটা চিন্তিত হওয়া উচিত?
এটি সার্স ভাইরাস থেকে আলাদা। সার্সের তুলনায় চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। তবে হুবাইতে, কয়েক হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং শত শত ব্যক্তিকে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে চিকিৎসা করা হচ্ছে। সেখানকার কর্মকর্তারা একে ‘চরম, তীব্র ও আকস্মিক জনস্বাস্থ্যের সঙ্কট’ বলে বর্ণনা করেছেন। আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, উহানের একটি হাসপাতাল স্বাস্থ্য কর্মীদের এবং অন্যান্য রোগীদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।

কর্তৃপক্ষ কী করছে?
চীন সরকার উহান এবং এই অঞ্চলের এক ডজনেরও বেশি শহরে একটি পৃথকীকরণ নীতি চাপিয়েছে, ফলে প্রায় ৫০ কোটিরও বেশি লোকের চলাচল আপাতত নিষিদ্ধ। প্রয়োজনের তাগিদে কয়েক দিনের মধ্যে নতুন হাসপাতাল তৈরি এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। ডাব্লুএইচও বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরী অবস্থা জারী করেছে। চীনে মূল ভূ-খণ্ড থেকে হংকংয়ে ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ অন্যান্য দেশ ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করার লক্ষ্যে চীন থেকে আগত অ-নাগরিকদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যদিও ডাব্লুএইচও বলছে, এই ধরনের ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয়।

কর্তৃপক্ষ কীভাবে কাজ করছে?
প্রথম দিকে চীনের প্রতিক্রিয়া প্রশংসামূলক হলেও এখন দেশটিকে বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। দেশটি ভাইরাস সম্পর্কে জেনেটিক তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করেনি এবং নতুন রোগী গণনা পদ্ধতিতে আনা পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতেও কালক্ষেপণ করছে। দেশটিতে এমনিতে ইন্টারনেট প্রচন্ডভাবে সেন্সর করা হয়েছে, সেখানে একজন চীনা চিকিৎসকের ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশের বিরল ঘটনা ঘটেছিল। আলোচিত ডাক্তার এই রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে প্রাথমিক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাকে চুপ করিয়ে রেখেছিল। অবশ্য উহান ও হুবাইয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পরে তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তথ্যসূত্র: ওয়াশিংটন পোষ্ট

 

টাইমস/এনজে/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিদেশি সম্প্রচার বন্ধ: বাইরের দুনিয়ার খবরাখবর থেকে বিচ্ছিন্ন উত্তর কোরিয়া Nov 04, 2025
img
ডিএসইর সূচক ৪ মাস আগের অবস্থানে, কমলো লেনদেনও Nov 04, 2025
img
রিজার্ভ চুরি মামলায় তদন্ত প্রতিবেদনের তারিখ ৮ ডিসেম্বর Nov 04, 2025
img
আমরা কিভাবে বেঁচে থাকতে চাই?: চঞ্চল চৌধুরী Nov 04, 2025
img
বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিয়ে আদানির চিঠি Nov 04, 2025
img
রোমে মধ্যযুগীয় টাওয়ার ধসে প্রাণ গেল শ্রমিকের Nov 04, 2025
img
নিবন্ধন পেলো ৩ রাজনৈতিক দল: ইসি সচিব Nov 04, 2025
img
৪১ জন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও ৬৭ জন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ Nov 04, 2025
img
শেখ হাসিনা আজ দেশছাড়া, রয়ে গেছে প্রথম আলো: মতিউর রহমান Nov 04, 2025
img
সেঞ্চুরি করে মুশফিকের ‘খ্যাপাটে’ উদযাপন Nov 04, 2025
img
অভিবাসীদের ওপর কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে ফিনল্যান্ড Nov 04, 2025
img
ফেসবুকের মতো কভার ফটো দেওয়া যাবে হোয়াটসঅ্যাপে Nov 04, 2025
img
জাতীয় দলে আশরাফুল-রাজ্জাকের অন্তর্ভুক্তির কারণ Nov 04, 2025
img
নিক্সন চৌধুরী ও তার স্ত্রীসহ ৪ জনের আয়কর নথি বিবরণী সিআইডিকে প্রদানের নির্দেশ Nov 04, 2025
img
মেহেরপুরে মনোনয়ন ঘিরে দু’পক্ষের সংঘর্ষ, বিএনপি কার্যালয়ে ভাঙচুর Nov 04, 2025
img
বিমানবন্দর থেকে অস্ত্র চুরির বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Nov 04, 2025
img
জামায়াত আমিরকে নিয়ে শফিকুল ইসলাম মাসুদের আবেগঘন পোস্ট Nov 04, 2025
img
দক্ষিণ কোরিয়া সফরে পিট হেগসেথ Nov 04, 2025
img
চলতি মাসে হবে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট মহারণ Nov 04, 2025
img
অনেক বেশি এক্সাইটেড, টিম ছাড়া কিছু বলতে চাই না : তানজিন তিশা Nov 04, 2025