ক্লাসে ড্যাম কেয়ার সেই ছেলেটির অক্সফোর্ডে চান্স পাওয়ার গল্প

২০১২ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হই। প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে বেশ তিড়িং-বিড়িং করতে ভালবাসতাম। নবীন বরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করার সময় বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা মুশতাক স্যারের সাথে পরিচয় হয়। লোকটা বেশ হাসি-খুশি, বন্ধু সুলভ মানুষ। ঐ বছরের শেষ দিকে মুশতাক স্যার পিএইচডি করতে অক্সফোর্ডের পাড়ি জমান। বিখ‍্যাত শেল্ডনিয়ান থিয়েটারের সামনে তার ম‍্যাট্রিকুলেশনের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিলেন। সেই ছবিটা দেখে সর্বপ্রথম আমার মনে হয়— “অক্সফোর্ডে পড়তে যাবো।”

এটা খুব একটা যুক্তি নির্ভর সিদ্ধান্ত না, খানিকটা আবেগপ্রবণও বটে। তাই, প্রথমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য www.ox.ac.uk সাইটে ঢুকে ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। আমি তখন মাত্র প্রথম বর্ষের ছাত্র। নিজের পিএইচডি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজছিলাম। বেশ ইচড়ে পাঁকা আচরণ বটে!

দ্বিতীয় আর তৃতীয় বর্ষের মাঝেই আমি মোটামুটি অক্সফোর্ডে পড়ার সব নিয়ম কানুন জেনে নিলাম তাদের ওয়েবসাইট থেকেই। আর নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য লেখা পড়ার পাশাপাশি ১০ মিনিট স্কুলে কাজ করতাম। যেহেতু আমি জানতাম লক্ষ হলো অক্সফোর্ড, সেহেতু সবসময়ই নিজের সিজিপিএ, গবেষণার অভিজ্ঞতাগুলোকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি।

চতুর্থ বর্ষ শুরু হতেই আমি একটু নড়ে চড়ে বসলাম। আমার হাতে আবেদন করার সব তথ‍্য আছে, যোগ‍্যতাও সেই বছরের মাঝেই চলে আসবে। এখন দরকার ভালো একটা পরিকল্পনা। সেই চিন্তা থেকেই অক্সফোর্ডে পড়ুয়া মুশতাক স্যার আর বাঁধন ভাইয়ের সাথে কয়েকবার মেসেঞ্জার কলে আলোচনা করে নিলাম। আমি কখনোই তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতাম না, “অক্সফোর্ডে পড়তে কত সিজিপিএ লাগে?”। বরং আমি ওয়েবসাইট থেকে সব তথ‍্য সংগ্রহ করে আমার সিদ্ধান্তহীনতার জায়গাগুলো নিয়ে প্রশ্ন করতাম। এই দুজনের ব‍্যক্তিগত মেনটরিং আমাকে অসম্ভব সাহায‍্য করেছে।

গবেষণায় ব্যস্ত শামির মোন্তাজিদ

স্নাতক পাশ করার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটখানা হাতে নিয়ে অক্সফোর্ড পিএইচডি’র আবেদন করতে বসে যাই। ততদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স কোর্সও শুরু করে দিয়েছি। প্রথম বড় মাইলফলক হল, একজন সুপারভাইজার খুঁজে বের করা। বিভাগের সাইট থেকে বিজ্ঞানীদের লিস্ট দেখে তাদেরকে ইমেইল করে কথা বলার চেষ্টা করতে হয়। এক্ষেত্রে কারো রেফারেন্সে ইমেইল করলে উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। কারণ সবাই পরিচিত মানুষের সাথে কাজ করতে বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।

আমি আমার বস সাজিয়াকে প্রথম ইমেইল পাঠালাম ২০১৬ সালের নভেম্বরে। সেই ইমেইলে তার পূর্বের গবেষণা পত্রগুলো পড়ে সে সম্পর্কিত খানিকটা আলোচনা করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আমি তার কাজের সাথে পরিচিত। এ ইমেইল লিখতে সপ্তাহখানেক ধরে পড়াশোনা করতে হয়। প্রতিটা বিজ্ঞানীর জন্য এই ইমেইলা ভিন্ন হবে। এর সাথে জুড়ে দিতে হবে নিজের সিভি এবং ট্রান্সক্রিপ্ট। সাথে তৃতীয় কোন উৎস (যেমন-কমনওয়েথ, সরকারি বৃত্তি) থেকে ফান্ডিং পাবার সম্ভাবনার কথা বলতে পারলে তো পোয়াবারো। নিজস্ব ফান্ডিং নিয়ে যারা অক্সফোর্ডে আসতে পারে তাদের জন্য চান্স পাওয়া অনেক সহজ বলে আমি মনে করি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারও এই ফান্ডিং দিয়ে থাকে। বাংলাদেশও তার মধ‍্যে অন্যতম।

দু’দিন পর সাজিয়ার উত্তর আসলো। আমাদের মাঝে ঘন্টা খানেক স্কাইপ আলোচনাও হলো। সেই ভিডিও কলটা মোটেও প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিলো না। পুরো কলটাই ছিলো একটা আলোচনা। আমি নিজে ক‍্যান্সার নিয়ে কি চিন্তা করি সাজিয়া সেটাই জানতে চেয়েছিলো। এতে করে বুঝতে পারলাম, পিএইচডি জীবনে কাজ করতে গেলে বসের সাথে যুক্তিনির্ভর আলোচনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। “জি ম‍্যাডাম, আপনি যা বলবেন সবই ঠিক।”—টাইপের উত্তর দিলে বসেরা নিরাশ হবেন।

অত:পর আমি অক্সফোর্ডে আবেদন করলাম। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ‍্যালেন্টাইন্স ডে’-তে অক্সফোর্ডের অফার লেটার আসলো। আমার খুশি হবার কথা। কিন্তু, মনটা বেশ খারাপ! কারণ, চান্স পেলেও আমি অক্সফোর্ডের স্কলারশিপ পাইনি। কারণটাও বেশ সহজ-সরল। নন-ইউরোপীয়ানদের যুক্তরাজ‍্যে পড়তে তিনগুণ বেশী টিউশন ফি দিতে হয়। তাই, বিভাগীয় বৃত্তিগুলোর অধিকাংশই ইউরোপিয়ান জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ থাকে। যে দু-একটা নন-ইউরোপিয়ান বৃত্তি থাকে সেটা হার্ভার্ড অথবা এমআইটির কেউ বাগিয়ে নেয়। সুতরাং, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি আবেদন করে সেই দৌড়ে অক্সফোর্ডে বৃত্তি পাওয়াটা বেশ কঠিনই। সুতরাং, আমি অক্সফোর্ডের অফার লেটার হাতে নিয়ে স্কলারশীপের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগলাম। আগা-খান ফাউন্ডেশন, রোটারি ক্লাব, ওআইসি সহ মোট ২৭টা জায়গায় আবেদন করলাম। একে একে ২৭ জায়গা থেকেই রিজেকশন আসলো। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে বুঝতে পারলাম, টাকার অভাবে অক্সফোর্ডে যেতে পারবো না।

এ অবস্থায় সমাজ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। সবাই বললো, আমি জিআরই দিলে সহজেই আমেরিকায় স্কলারশীপ পেয়ে যাবো। ইংল‍্যান্ড নাকি থাকার জন‍্য ভালো না। ইত‍্যাদি, ইত‍্যাদি..

আমি শুধু মনে মনে ভাবলাম, একবার ব‍্যর্থ হয়েছি বলে হাল ছেড়ে দিতে হবে? কখনোই না!
আমার বস সাজিয়া অন্তত আমাকে বেশ পছন্দ করেছিলেন। তিনি সে বছর শুধু অ‍্যাকাডেমিক ভিজিটর হিসেবে তিন মাসের জন্য আমাকে অক্সফোর্ডে যেতে আমন্ত্রণ জানালেন। এই কাজটা উনি কেন করেছেন তার উত্তর আমার জানা নেই। তার কেন যেন ধারণা ছিল, আমি ভালো কাজ করতে পারবো (যেটা বছর দুয়েকের মধ‍্যে আমি সফলতার সাথে ভুল প্রমাণ করতে পেরেছি!)।

২০১৭ সালের নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শেষ করেই উড়াল দিলাম অক্সফোর্ডে। তিন মাস দিন রাত খেটে বসের সামনে প্রমাণ করার চেষ্টা করলাম যে, “আমি পারবো।” বসও খানিকটা সায় দিলেন। সে বছর আমি আবারো অক্সফোর্ডে আবেদন করলাম। যেহেতু এবার অক্সফোর্ডে বসে আবেদন করেছি, সেহেতু একটু বেশী গুরুত্ব পেলাম বলে মনে হলো। তারা আমাকে ইন্টারভিউতে আমন্ত্রণ জানালো। আমি আমার মাস্টার্সের থিসিসটা প্রেজেন্ট করলাম। ৩০ মিনিট ধরে সবাই সেটা নিয়ে প্রশ্ন করলো। আমি সাধ‍্যমত উত্তর দিলাম। কিন্তু, দিন শেষে আবারো একটা স্কলারশীপ বিহীন অফার লেটার পেলাম। বুঝতে পারলাম, অক্সফোর্ডের কাছ থেকে বৃত্তি পাবার আশা বাদ দিতে হবে।

আমি উঠে পড়ে লাগলাম আমার অন্যান্য উৎসগুলোতে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় সম্ভাবনা হলো বাংলাদেশ সরকারের “বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ” এবং “প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপ”। আমি অফার লেটার সহ এই দু’জায়গায় নিজের আবেদন পাঠিয়ে দিলাম। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে অবশেষে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপের জন্য মনোনীত হলাম। সেই ২০১২ সাল থেকে দেখে আসা স্বপ্ন টানা দুই বছরের আবেদন প্রক্রিয়া, ২৭টি রিজেকশন আর বেশ কিছু বিনিদ্র রজনীর বিনিময়ে অবশেষে সত‍্যি হলো। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে আমি অক্সফোর্ডে নিজের পিএইচডি যাত্রা শুরু করি। বর্তমানে গবেষণা করছি স্টেম সেল নিয়ে।

আমি জানি, অক্সফোর্ডে চান্স পেতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এর থেকে অর্ধেক কষ্ট করলেই হয়তো অন্য কোথাও চলে যেতে পারতাম। হয়তো আরো এক বছর আগেই পিএইচডি শুরু করতে পারতাম। কথা মিথ‍্যা নয়, সত‍্যি। আমি নিজেকে শুধু একটা কথা বলেই উৎসাহিত করতাম— “একদিন শেল্ডনিয়ান থিয়েটারের সামনে আমিও অক্সফোর্ডের গাউন পড়ে দাঁড়াতে পারবো। সেটা দুনিয়ার আর অন্য কোথাও পাবো না।”

অবশেষে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর সেই দিনটা আসলো। অক্সফোর্ডের ব‍্যালিয়ল কলেজের মেডিকেল সায়েন্সের ডিফিল ডিগ্রির জন্য ম‍্যাট্রিকুলেট করার মাধ‍্যমে গবেষণা জীবন শুরু করলাম। সেদিন ডিগ্রির হ্যাটটা হাতে ধরে রাখতে হয়, পড়তে মানা। চারবছর পর যেদিন ডিগ্রি শেষ হবে সেদিন আবারো এই শেল্ডনিয়ান থিয়েটারে আসবো। হয়তো সেদিন হ্যাটটা পড়ে বের হবার সৌভাগ‍্য হবে।

লেখক : শামির মোন্তাজিদ
শিক্ষার্থী, Medical Sciences, University of Oxford

টাইমস/জেকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পারমাণবিক নিরাপত্তা চুক্তির প্রস্তাব অনুমোদন Jul 03, 2025
img
পিআর পদ্ধতিতে ভোট হলে স্থানীয় পর্যায়ে নেতা ও নেতৃত্ব তৈরি হবে না : রিজভী Jul 03, 2025
img
রাজবাড়ীতে চাঁদা না পেয়ে বালু ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম Jul 03, 2025
img
যাত্রাবাড়ীর হত্যা মামলায় শরীয়তপুরের সাবেক মেয়র গ্রেফতার Jul 03, 2025
যে ১টা কারণে আপনি ধরা খেতে পারেন Jul 03, 2025
img
তাবেলা সিজার হত্যা মামলার রায়: তিন আসামির যাবজ্জীবন, খালাস ৪ Jul 03, 2025
ফর্মহীন লিটন দাস ! ৮ ইনিংসে মাত্র ১৩ রান, কেন এমন অবস্থা? Jul 03, 2025
বলিউডে অভিষেক শানায়ার, ছবির ট্রেইলার দেখে আবেগাপ্লুত বাবা সঞ্জয় কাপুর Jul 03, 2025
বাতিল প্রতীকী ব্ল্যাকআউট, বহাল থাকবে বাকি আয়োজন Jul 03, 2025
যুদ্ধ নয়, শান্তির পথে বিশ্বের নিরপেক্ষ ১২টি দেশ Jul 03, 2025
শাপলা পেতে ‘মরিয়া’ নাগরিক ঐক্য, আশাবাদী এনসিপিও Jul 03, 2025
ভ্যাপসা গরমে জাবি ছাত্রদলের মানবিক সাড়া Jul 03, 2025
img
জামায়াতের সঙ্গে জোট হয়নি, পিআর পদ্ধতি চায় গণঅধিকার Jul 03, 2025
প্রতারণা করে কোটি টাকা লো'পা'ট;ফুডপান্ডার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা! Jul 03, 2025
img
বাংলা নাটকে দর্শকপ্রিয়তার শীর্ষে যে ছয়জন অভিনেত্রী Jul 03, 2025
‘আশুরা’ উপলক্ষে যেসব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিচ্ছে ডিএমপি Jul 03, 2025
img
কর্মচারীদের বিক্ষোভের মুখে দাবি মেনে নিল এনাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ Jul 03, 2025
img
জুলাই সনদ: মুক্তিযুদ্ধকে সবার উপরে রেখে ‘রাজনৈতিক দলিল’ হিসেবে চায় বিএনপি Jul 03, 2025
img
অনন্যাকে কষ্ট দিয়ে সারার সঙ্গে নতুন সম্পর্কের কথা বললেন আদিত্য Jul 03, 2025
img
লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে শাকিবের সিনেমা দেখেন অভিনেতা আরশ খান Jul 03, 2025