করোনায় ডাক্তার ছেলেকে হারিয়ে মায়ের আবেগঘন স্ট্যাটাস!

আমাদের ডাক্তারি পড়ুয়া প্রিয় সন্তানকে হারিয়েছি গতকাল। এর চেয়ে বেদনার দিন কোনো মায়ের এই পৃথিবীতে নেই। প্রচন্ড শোকের মাঝে অন্য সব মায়ের এই বার্তা দেয়ার একমাত্র কারণ হল, আর কোনো মাকে যেন এইভাবে তার সন্তানকে হারাতে না হয়।

আমি শুধু মা না। আমি একজন ডাক্তার। আমার স্বামীও ডাক্তার। মাত্র ২১ বছরে আমাদের শোকের মাঝে রেখে চিরতরে চলে যাওয়া আমার ছেলেও মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী। আমার ছেলের শারীরিক কোনো সমস্যা ছিলনা। একজন স্বাস্থ্যবান তরতাজা যুবক ছিল। প্রচণ্ড মানসিক, শারীরিক শক্তি ছিল। বন্ধুবৎসল ছিল। সবসময় প্রাণোচ্ছল ছিল। পাশাপাশি সে তুখোড় মেধাবী একজন ছাত্র ছিল। মা-বাবার মতো ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে তার অধ্যয়নে কোনো ঘাটতি ছিলনা। কিন্তু মাত্র ৭২ ঘন্টার মাঝে আমাদের জীবনের সবকিছু উলটপালট হয়ে গেল।

লকডাউনে সে কোথাও যায়নি। মাত্র দুবার পাঁচ মিনিটের জন্য নিজের গাড়িতে করে বাইরে যায়। আর ঘরে ফেরার সাথে সাথে নিজের শরীরকে ভালো করে ধৌত করে। সচেতনতার কোনো ঘাটতি ছিলনা-আমাদের পরিবারে। যেহেতু সে নিজেই ডাক্তারি পড়ছে আর আমরা ডাক্তারি পেশায় আছি।

ঈদের আগের দিন রাতে সে দুই বন্ধুর সাথে বড়জোড় দুই-আড়াই ঘন্টার জন্য বাইরে যায়। এর পর ঘরে এসে গোসল করে শুতে যায়। পরদিন সকালে সে সামান্য মাথা ব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে। আমি ওকে Panadol tablet খেতে দেই।

মাথা ব্যথা না কমলে- চারপাশে ঘটা বর্তমান পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে আমি ওর শরীরের তাপমাত্রা নেই। দেখি ৯৯ ডিগ্রি। সাথে সাথে ওকে আমি অন্য একটা ঘরে আলাদা করে দেই। চব্বিশ ঘন্টার ভিতরে ওর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে হয় ১০১ । আমি ওকে Panadol+Brufen দেই। সে তার ঘাড়েও ব্যথা অনুভব করে। আমার Pediatrician স্বামী মনে করেন -ছেলের হয়তোবা Meningitis হতে পারে। কিন্তু ওর কোনো বমি বা বমির কোনো ভাব নেই। আমরা দ্রুত টেস্টের জন্য ব্লাড স্যাম্পল পাঠাই এবং ডাক্তাররা বলেন - ওর Bacterial Meningitis হয়েছে এবং এন্টিবায়োটিকস দেয়া শুরু করি এবং
আধ ঘন্টার ভিতরে ওকে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করি। সবসময় আমি ওর সাথে ছিলাম। ওর কোনো ঠাণ্ডা, গলা ব্যথা, কাশি, বুক ব্যথা, পেট ব্যথা এসবের কিছুই ছিলোনা। ডাক্তাররা মনে করছেন, Meningitis ই হয়েছে। নিউরোসার্জন এসে দেখে গেলেন- এবং CT স্ক্যান করা হলো নিশ্চিত হতে আমার ছেলের অন্য কোনো সমস্যা নেই। এ সময় লক্ষ করলাম ওর একটা চোখের কিছু অংশ ফোলা। বুকের এক্সরে করে দেখা যায় ছোট একটা দাগ। ইতোমধ্যে কোভিডের রেজাল্ট আসে। আমার ছেলে করোনায় আক্রান্ত। পরের ৮- ১০ ঘন্টা ছিল জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণার দিন। ওর হার্ট রেট, রেসপাইরেটরি রেট বাড়ছেই, অক্সিজেন লেভেল ড্রপ করছে। প্রতি মুহুর্তে ছেলে আমাদের চোখের সামনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা কেউ কিছুই করতে পারছিনা। কিছু বুঝে ওঠার আগে ছেলে চোখ বন্ধ করে। ও আমাদের ছেড়ে চলে যায়।

ইতোমধ্যে আমার স্বামীরও করোনা পজিটিভ রেজাল্ট আসে। তাকেও আলাদা করা হয়। মেডিকেল প্রসিডিউর অনুযায়ী আমার সন্তান সালমানের যানাজা, দাফন হয়। কাউকে জড়িয়ে ধরে যে কাঁদবো, সেই সুযোগও হয়না। কেউ হাসপাতালে ওয়ার্ডে ভর্তি হচ্ছে । কেউ লাশের গাড়িতে করে সরাসরি কবরস্থান, শশ্মানে চলে যাচ্ছে। কারো পাশে কেউ নেই। আমার সন্তানকে তো আমরা হারিয়েছি। এই শোক এই পৃথিবীতে আর কোনোদিনও কাটিয়ে ওঠতে পারবোনা।

তাই, নিজের সন্তানকে হারানোর আগে দয়া করে আমার কথাগুলো শুনুন।

এক) ভুলেও মনে করবেন না যে, আপনার করোনা হবেনা। আপনার নিজের না হলেও হয়তোবা আপনি করোনা ভাইরাসের বহনকারী হবেন। আমাদের যেটা মনে হচ্ছে- আমি আর আমার স্বামী প্রতিদিন নিজ নিজ কাজে গেছি। আর হয়তোবা আমরা নিজেরাই আমাদের সন্তানের জন্য বহন করে নিয়ে এসেছি। আর বেচারা ঘরে বসে থেকেই আমাদের কাছ থেকে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।

দুই) এখনও সময় আছে সতর্ক হোন। অধৈর্য্য হয়ে ঢিলেঢালা হয়ে চলাটা আপনার জন্য ঠিক মনে করলেও ভাইরাস কিন্তুু সেটা মনে করছেনা। তাই, যাবতীয় জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। এখন, জীবনের তাগিদে যদি কাউকে বাইরে যেতে হয়- সেক্ষেত্রে কি বলা দরকার সেটা আমার জানা নেই।

তিন) একজন ডাক্তার হিসেবে infertility treatment'র জন্য আমি প্রতিদিন ফোন কল পাচ্ছি। আপনাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ দশবছর অপেক্ষা করতে পেরেছেন। সারা জীবন নিজের জন্য বাঁচতে এবং অন্যকে বাঁচাতে কেন মাত্র আরো ছয়টি মাস অপেক্ষা করতে পারছেন না। প্লিজ ধৈর্য্য ধরুন।

চার) সরকারের দেয়া নির্দেশনা খুবই কড়াকড়িভাবে মেনে চলুন। একজন আরেকজনকে দোষারুপ করলে কিছুই হবেনা। নিজ নিজ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক না হলে এই মৃত্যু মহামারী আটকানো যাবেনা। হাসপাতালের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা পেয়ে, নিজে ডাক্তার, নিজের স্বামী ডাক্তার হওয়ার পরও আমাদের সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি।

পাঁচ) আপনাদের মাঝে যারা বলছেন- এসব মিথ্যা। শুধু টাকা আয় করবার কৌশল। তাদেরকে বলছি- আমাদের সব সম্পত্তি দিয়ে দিতে চাই। শুধু আমাদের সন্তানকে একটিবার ফিরিয়ে দিন।

ছয়) যারা মনে করছেন, আমাদের আর করোনা হবেনা। হওয়ার থাকলে এতোদিনে হয়ে যেতো। বিশ্বাস করেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই জীবন শেষ হয়ে যাবে। কিছুই বুঝতে পারবেন না। জীবন-মরণ আমাদের হাতে না। কিন্তু সাবধান থাকা আমাদের হাতে। তাই, সতর্ক হোন, সাবধান হোন। আর কোনো মাকে যেনো আমার মতো হাহাকার করতে না হয়।
"রাব্বুল আলামীন এই দুঃসময়ে সবার প্রতি সহায় হোন"

বিনীত,
করোনায় মারা যাওয়া সালমান তাহিরের এক দুঃখী মা।

[বি:দ্র: সালমান তাহির একজন পাকিস্তানি তরুণ
তার মায়ের আবেগঘন স্ট্যাটাসটি ফেইসবুক থেকে নেয়া]

টাইমস/জেকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
নতুন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই ব্যবসা চলবে না : সাদিক কায়েম Nov 08, 2025
img
ভিয়েতনামে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ১ বাংলাদেশির Nov 08, 2025
img
‘এখন যুবলীগের কার্যক্রম নেই, তাই এনসিপিতে এসেছি’ Nov 08, 2025
img
সাতক্ষীরায় ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত করতে হবে : হাবিব Nov 08, 2025
img
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে দেশ মহাবিপর্যয়ে পড়বে : প্রিন্স Nov 08, 2025
img

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

সাইবার অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু Nov 08, 2025
img
রিজভীর পা ধরে সালাম করা সেই সার্জেন্টকে প্রত্যাহার Nov 08, 2025
img

প্রশ্ন সায়ন্থের

ঘি খেতে চাইলে চামচ দিয়ে ভদ্রভাবে খান, আঙুল বাঁকিয়ে কেন ? Nov 08, 2025
img
নগরকান্দায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মিজান গ্রেপ্তার Nov 08, 2025
img
ইসলামী মূল্যবোধকে জিয়াউর রহমান সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন: মাহাদী আমিন Nov 08, 2025
img
বিশেষ অভিযানে মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার ৩৭ Nov 08, 2025
img
সিরাজগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল কৃষকদলের দুই নেতার Nov 08, 2025
img
শাটডাউনে হাজারো ফ্লাইট বাতিল যুক্তরাষ্ট্রে Nov 07, 2025
img
গণভোটের তারিখ ঘোষণা করতে হবে : গোলাম পরওয়ার Nov 07, 2025
img
জগন্নাথের ১৫ শিক্ষার্থীকে নিয়ে নৌকাডুবি Nov 07, 2025
img
নিজেদের ভাবনার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি: সন্দীপ্তা সেন Nov 07, 2025
পিতা মাতার প্রতি ছেলের কর্তব্য | ইসলামিক জ্ঞান | Nov 07, 2025
ফেলানি নিয়ে মুক্তি পেল জাতীয় নির্বাচনের দ্বিতীয় টিজার Nov 07, 2025
প্রস্তুত ইসি, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন Nov 07, 2025
আ.লীগ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বললেন ব্যারিস্টার ফুয়াদ Nov 07, 2025