তাদের কাছে মদ খাওয়ার লাইসেন্স আছে!

‘লাইসেন্স টু কিল’ ধারণাটি জেমস বন্ড সিরিজের কল্যাণে সাধারণের কাছে ব্যাপক পরিচিত। হত্যা সকল সমাজেই গর্হিত বিষয়, তারপরেও কাল্পনিক চরিত্র জেমস বন্ডের কাছে মানুষ হত্যার বিশেষ অনুমতিপত্র বা লাইসেন্স আছে। জেমস বন্ডের কোড ‘007’ এবং ‘00’ কোডের ধারক সকল এজেন্টের জন্যই মানুষ খুন অনুমোদিত।

মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে নিষিদ্ধ, মাদক গ্রহণ দেশীয় সমাজের চোখে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কিন্তু বিশেষ ধরণের মাদক গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ শ্রেণীর লোকেদের জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থাও আমাদের দেশে বিদ্যমান। সরকার যেমন কাল্পনিক চরিত্র জেমস বন্ডকে মানুষ খুনের অনুমতি দেয়, সবাইকে দেয় না। তেমনি প্রশাসন আমাদের দেশে মদ্যপানের ‘বিশেষ’ অনুমতি প্রদান করে, তবে সবাই সেটা পায় না।

বাংলাদেশে দুই থেকে পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি তারকাযুক্ত হোটেল, পর্যটন বা কূটনৈতিক এলাকা, রেস্টুরেন্ট, ক্লাব ও ডিউটি ফ্রি শপে মদ বিক্রির অনুমতি আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত কেরু এন্ড কোম্পানি মদ উৎপাদনও করে। তাই লাইসেন্স থাকলে আপনিও দেশি-বিদেশি নানা ব্র্যান্ডের মদ পেয়ে যাবেন খুব সহজেই।

এখন আপনার কাছে তো লাইসেন্স নেই। আপনি যদি ভেবে থাকেন যাদের কাছে মদ খাওয়ার লাইসেন্স আছে, তারা হয়তো জেমস বন্ডের মতোই বিশেষ ব্যক্তিত্ব, তাহলে কিন্তু আপনি ভুল করবেন। মদপানের লাইসেন্স ধারীরা আসলে “অসুস্থ”! উহারা চিকিৎসার নিমিত্তে মদ্যপান করিয়া থাকেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর  ১১ ধারায় বলা আছে, “… চিকিৎসার প্রয়োজনে সিভিল সার্জন অথবা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অন্যূন কোনও সহযোগী অধ্যাপকের লিখিত ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত কোনও মুসলমানকে অ্যালকোহল পান করিবার জন্য পারমিট প্রদান করা যাইবে না।” যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে কোন সিভিল সার্জন অথবা সরকারি মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বা তার থেকে উঁচু পদমর্যাদার কারো কাছ থেকে লিখিত ব্যবস্থাপত্র সংগ্রহ করতে পারলে ‘লাইসেন্স টু ড্রিংক’ পাওয়া যেতে পারে।

এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, যে দেশে টাকা হলে কোভিড-১৯ নেগেটিভের সার্টিফিকেট পাওয়া সম্ভব সেদেশে মদ পানের জন্য ব্যবস্থাপত্র সংগ্রহ করা কি খুব কঠিন কিছু? তাছাড়া এমন কোন রোগ আছে মদ না খাইয়ে বর্তমানে যার চিকিৎসা করা সম্ভব নয়? যদি থেকেও থাকে সেটা আইনে স্পষ্ট করার দরকার ছিল বলেই মনে করি।

২০১৮ সালে ‘দ্যা ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় এ বিষয়ে “লাইসেন্স অব লাইস” নামে ইনাম আহমেদ ও সাখাওয়াত লিটনের একটি নিবন্ধ প্রকাশ হয়। সেখান থেকে কয়েকটা লাইন আমি অনুবাদ করছি, “কেউ যদি পুলিশের হয়রানি এড়াতে চায়, তাকে শুধু কোনও একটা বার কিংবা লাইসেন্স ধারী অ্যালকোহল বিক্রেতার কাছে যেতে হবে, এবং ২,০০০ টাকা বৈধ ফি আর তার সাথে বাড়তি কিছু টাকা দিতে হবে। কিছুদিনের মধ্যেই ‘চিকিৎসার কারণে’ আপনার অ্যালকোহল গ্রহণ প্রয়োজন এমন ব্যবস্থাপত্র সহ লাইসেন্স প্রস্তুত হয়ে যাবে।”

যাইহোক, যুক্তির খাতিরে ধরে নিচ্ছি বাংলাদেশে মদ্যপানের লাইসেন্স ধারী মুসলমানেরা সবাই অসুস্থ, মদ ছাড়া তাদের চিকিৎসাও হয় না। আহা কি কঠিন সে অসুখ, মদ না খেলে সারে না! এখন কথা হচ্ছে, অসুস্থ রোগীদেরকে ক্লাবে বা বারে বসে মদ খেতে হবে কেন? নাকি ডাক্তারের দেয়া ব্যবস্থাপত্রে এটাও লেখা থাকে যে ক্লাবে বা বারে বসে মদ খেলে দ্রুত রোগ সারে? ওটা লেখা না থাকলে রোগীর জন্য ফার্মেসীতে মদ বিক্রি হোক, ক্লাবে বা বারে বসে মদ খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে কেন?

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিদেশী মদপানের লাইসেন্স ধারীর সংখ্যা ছিল ১৩,০০০ এবং দেশী মদ খাওয়ার লাইসেন্স ছিল ২৮,০০০ ব্যক্তির। সে সংখ্যা গত ৩ বছরে বেড়েছে, কমেনি। তার মানে দাঁড়াচ্ছে চিকিৎসার জন্য মদ প্রয়োজন এমন রোগীর সংখ্যা নেহাত কম নয়।

কোভিড-১৯ আক্রান্তদের জন্য যেমন আলাদা ওয়ার্ড করা হয়েছে, এদের জন্য প্রয়োজনে হাসপাতালে আলাদা ওয়ার্ড করা হোক, এরা হাসপাতালের বেডে শুয়ে-বসে মদরূপে ওষুধ সেবন করুক। তাছাড়া ক্লাবে বা বারে বসতে অনেক টাকা দরকার। তাই গরিব লোকেরা যদি এই রোগে আক্রান্ত হয়, তাদের জন্য সরকারি ভর্তুকির ব্যবস্থা থাকা উচিত। একজন গরীব লোক ওষুধ হিসেবে মদ খাওয়ার জন্য এত টাকা ফি দিয়ে কেনই বা লাইসেন্স করতে যাবে? জনস্বার্থে লাইসেন্স তো নামমাত্র মূল্যে হওয়া উচিত, কিংবা একেবারে বিনামূল্যে দেওয়া হোক। মদের উপর থেকে অতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্স তুলে নেয়া হোক। ওষুধের উপর এত ভ্যাট-ট্যাক্স কেন ভাই? নাকি এই রোগ শুধু বড়লোকের হয়?   

ধরে নিলাম এ অসুখ কঠিন অসুখ, মদ ছাড়া এর চিকিৎসা নেই, শুধু বড়লোকেরা এতে আক্রান্ত হয় এবং ক্লাবে বা বারে বসে মদ খেলে দ্রুত রোগ সারে। খুব ভাল কথা।  এখন আসুন আমরা ‘সিসা বার’ কিভাবে বন্ধ করা যায় সে নিয়ে বড় বড় কথা বলি, আর লম্বা লম্বা আর্টিক্যাল লিখি। সিসাতে নিকোটিন থাকে, সিসা ভয়ানক মাদকদ্রব্য। আসুন আমরা এনার্জি ড্রিংকের বিরুদ্ধেও দুর্বার সংগ্রাম ঘোষণা করি, কারণ আমাদের দৌড় ওই পর্যন্তই।

সিসা বা এনার্জি ড্রিংক সেবনে দেশ ও জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু মদপানে মিলবে রোগমুক্তি। তাই মদের (পথ্যের) বারগুলি খোলা থাক, ক্লাবগুলিতে সারা রাত অসুস্থ রোগীদের মদ পানের (ওষুধ সেবনের) উদ্দাম পার্টি চলুক।

তবে যদি এত ধরা-ধরির মধ্যে না যাই, তাহলে সহজ কথা সরাসরি বলতে হবে। মদপান উন্মুক্ত হলে সেটা সবার ক্ষেত্রেই উন্মুক্ত হওয়া উচিত। পশ্চিমবঙ্গে মদ নিয়ে এত বিধি নিষেধ নেই, তাই বলে সেখানকার সব মুসলমান মদখোর হয়ে গেছে একথাও কেউ বলতে পারবে না। সে হিসাবে বাংলাদেশে মদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে সব মুসলমান মদখোর হয়ে যাবে এটা ভাবারও কোন কারণ নেই। যার ঈমান আছে, তাকে ফ্রিতে মদ দিলেও সে খাবে না।

তবে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি মদ্যপান বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে সেটা সকল মুসলমানের জন্য সমান ভাবে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। ইসলাম সবার জন্য সমান, তাই কারো জন্য লাইসেন্স করে মদপানের সুযোগ রাখা উচিত নয়। একই সাথে মদকে বিশেষ মাদকদ্রব্য বিবেচনারও কোনও সুযোগ নেই, অন্য দশটা মাদকদ্রব্যের ক্ষেত্রে যা বিধান মদের ক্ষেত্রেও একই বিধান কাম্য। ইসলাম কি হোটেল, বার বা ক্লাবে মদ বিক্রির অনুমতি দেয়? ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত কোন প্রতিষ্ঠান কি মদ উৎপাদন করতে পারে? এই বিষয়গুলিও ভাবতে হবে।

মদ নিষিদ্ধ হবে নাকি উন্মুক্ত হবে সে বিষয়ে মতামত দেয়ার মতো ধৃষ্টতা আমার নাই। তবে যাইহোক সবার জন্য যেন তা সমান হয়। অন্যথায় লাইসেন্স ধারী ব্যক্তিরা রাতে কোনও ক্লাবে বসে মদপান করে দিনের আলোতে মাদক বিরোধী মঞ্চে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করলেও তাদেরকে প্রশ্ন করা যাবে না। দে হ্যাভ লাইসেন্স টু ড্রিঙ্ক, তারা অসুস্থ!

 

লেখক: তরুণ সাংবাদিক।

Share this news on: