কুয়েত মৈত্রী হসপিটাল থেকে লিখছি: করোনার সাথে বসবাস (পর্ব-৩)

দুই ঘণ্টা পর ঘুম থেকে উঠে দেখি মোবাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়, ছোট ভাই আর বন্ধুদের এক গাদা কল, ইনবক্সে ম্যাসেজ আর নোটিফিকেশন। একবার চোখ বুলিয়ে বুঝলাম বন্ধু রাসেল আহমেদ আমাদের পরিবারের জন্য দোয়া চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বর্তমান শিক্ষার্থীদের সব চেয়ে বড় গ্রুপ 'আমরাই জাহাঙ্গীরনগরে' পোস্ট দেওয়াতেই এই অবস্থা।

এদিকে আর নজর না দিয়ে আব্বাকে নিয়ে ওয়াশরুমে গেলাম। উনাকে ফ্রেশ করিয়ে আসা মাত্রই দুইজন মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট এসে উপস্থিত। তারা আমাদের বাইরে বারান্দায় নিয়ে ব্লাড কালেকশন করলো তারপর আরেকজন এসে তিনজনকেই বুকের এক্সরে করাতে নিচে নিয়ে গেলো। এসব শেষ করে আমি আর মীম গোসল সেরে নিলাম। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে পড়াশোনা করেছি তাদের জন্য এই টয়লেটগুলো খুব পরিচিত। কোনো সমস্যাও মনে হয়না। দুইটি গোসলখানা, দুইটি টয়লেট, দুইটি বেসিন বাড়তি শুধু টাইলসে মোড়ানো আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পাশাপাশি ঠিক কমন ওয়াশ রুম না। মীমও আমার মত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে থেকে পড়াশোনা করা ছাত্রী তাই তারও সমস্যা হয়নি। গোসল শেষ করে এসে দেখি দুপুর ১২টা বেজে গেছে।

এর মাঝে ফোন দিয়ে একজন আমাদের নাম, বয়স নিয়ে নিলো। কি কি সমস্যা পাশাপাশি করোনার টেস্ট করিয়েছি কিনা জেনে নিলো। একটু পর একজন স্যাম্পল কালেক্টর এসে আমাদের কোভিড-১৯ এর স্যাম্পল নিলো। লোকাল স্যাম্পল কালেকশন আর এখানকার স্যাম্পল কালেকশনের মাঝে বিস্তর ফারাক। স্যাম্পল কালেকশনের ওপর করোনার রেজাল্ট অনেকাংশেই নির্ভর করে। যাইহোক আজকের দিনের মাঝে আর দৌড়াদৌড়ি নেই।

দুপুর ১টায় খাবার চলে আসলো। এখানকার খাবার দেবার ব্যবস্থা খারাপ না। ফয়েল প্যাকে করে পর্যাপ্ত ভাত আরেকটা প্যাকে সবজি, কক মুরগি একটি বড় পিস, একটি পলিতে ডাল এবং ডিম সেদ্ধ। প্রতিদিন দুপুরের মেন্যুতে একই আইটেম দেওয়া হয়।

আমাদের জন্য খাবারটা খারাপ না হলেও আব্বার জন্য একটু সমস্যাই হলো। উনি বাসার রান্না খেয়ে অভ্যস্ত। ওই দিনের মত উনি অল্প কিছু খেয়ে নিলেন। কিন্তু আব্বার অবস্থা বেশ খারাপ। বারবার টয়লেটে যেতে হচ্ছে। তার ওপর হাই কমোড না থাকায় চেয়ারে বসে টয়লেটে উনার সমস্যাই হচ্ছে। শারীরিক গঠনে উনি লম্বা চওড়া আর ফ্যাটি হওয়ায় এটা উনার জন্য কষ্টকর। তারপরেও সাময়িক এই সমস্যা মেনে নিতে হবে। তবে উনি অস্থির হয়ে যাচ্ছেন, ছটফট করছেন তাই সামলানো যেমন কঠিন হয়ে যাচ্ছে তেমনি মীম এর শরীরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। আমিও পেটে মধ্যম মানের পীড়া আর হালকা জ্বরে ভুগছি।

এমন সময় খবর এলো বাসার গৃহ পরিচারিকার (আমেনা) মাঝে একজনের শরীর খারাপ করেছে। আমি আম্মাকে বললাম পাঠিয়ে দিন। কিছু কাপড় আর তার বালিশ, চাদর, কাঁথাটা যেনো নিয়ে আসে। আমরা সবাই বাসা থেকে যার যার বালিশ কাঁথা চাদর নিয়ে এসেছি। যদিও এখানে রুমে ঢুকার সময় মশারিসহ সব কিছু দিয়ে দেয় তবুও নিজেরটা ব্যবহার করা ভালো।

আম্মা আমাদের ৩৫ বছরের বিশ্বস্ত ম্যানেজার ফজলু ভাইকে দিয়ে আমেনাকেও পাঠিয়ে দেয়। আমেনা আসার মাঝের সময় ডিউটি ডা. এসে ভিজিট করে। আর কি কি ওষুধ খায় এবং নতুন কি কি ওষুধ রোগীর ধরণ অনুযায়ী দিতে হবে তা নোট নিয়ে যান। এখানকার আয়া, ওয়ার্ডবয়, বাথরুম ক্লিনার, নার্স, ডা. সকলেই খুব ওয়েল প্রোটেকশন ব্যবহার করে। এখন পর্যন্ত আমি কারো চেহারা দেখার সুযোগ পায়নি। বাইরে থেকে যেমন শুনেছিলাম ডা. আসেনা, কেউ আসে না তেমন না বরং সারাক্ষণ বারান্দায় কারো না কারো উপস্থিতি। এর মাঝে একজন রুম পরিষ্কার করে মুছে দিয়ে গেলো আরেকজন ওয়ার্ডবয় এসে ডিজ ইনফ্যাক্ট স্প্রে করে দিলো। এই কাজগুলো প্রতিদিন রুটিন মাফিক হয়।

এর মাঝে আমার শরীর আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে কিন্তু আব্বার অবস্থাতো ভালো না। বার বার টয়লেট হচ্ছে, আমাকে নিয়ে যেয়ে আবার প্যানচেয়ার ডিজইনফ্যাক্ট করে আবার উনাকে রুমে এনে স্যালাইন খাওয়াতে হচ্ছে। নিজেও রাইস স্যালাইন আর ক্যাফেইন সমৃদ্ধ প্যারাসিটামল খাচ্ছি যেনো শরীরের শক্তি না হারাই। আমি একই সিনড্রোমে ভুগেছি মাস ২ আগে, যদিও ওইবারও লোকাল টেস্টে করোনা নেগেটিভ আসে। আমি বাসাতেই চিকিৎসা নিয়েছিলাম এমনকি ৬ লিটার স্যালাইন পুশ করা লেগেছিলো। ভালো হয়েও শরীর অনেক দুর্বল হয়ে যায় যে, আমাকে অফিস থেকে বিনা বেতনে ছুটি নিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে আমার অফিসও অনেক সহযোগিতা করে। অনেকটা সুস্থতার দিকে যাচ্ছিলাম যখন তখন ২১ জুনের পর আব্বা অসুস্থ হলে আবার আমারও পেটে আগের মত সমস্যা সৃষ্টি হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে কয়েকবার ডাইরিয়া বা আমাশয়ের মত হয়, তারপর থেমে যায়। তবে এইবার তার পরিমাণ কম এবং আগের মত আমাকে দুর্বল করতে পারছে না যেমনটা আব্বাকে আমার প্রথম বারের মত করেছে।

এখন পর্যন্ত বাড়তি সুবিধা এইটুকু যে এখনো মীম নিজেরটা নিজে করে নিচ্ছে, কিন্তু আমি জানি এখন হয়তো ভালো আছে কিন্তু যেকোনো সময় খারাপ হবার সম্ভাবনা আছে। আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা তাই বলে।

হঠাৎ মনে হলো আব্বার ইনসুলিনগুলো ফ্রিজে রাখতে হবে। কন্ট্রোল রুমে ফোন দেবার পর বলল এই ফ্লোরে ফ্রিজ নেই, বাকী সব ফ্লোরেই আছে। কিন্তু বাকীগুলো পজিটিভ ওয়ার্ড, ওইখানে যাওয়া যাবেনা। এমন সময় প্রান্তিকের কথা মনে হলো। প্রান্তিক আমার চাচাত বোনের ছেলে, করোনা পজিটিভ হয়ে সে আর তার আব্বা ভর্তি। প্রান্তিক পজিটিভ হলেও সিনড্রোম নেই তার বাবা আব্দুল হালিম উকিল নালিতাবাড়ি পৌরসভার সাবেক মেয়র, বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। তিনি আইসিইউতে ভর্তি। প্রান্তিককে ফোন দিতেই সে এসে তার নানা ভাই এর ইনসুলিনগুলো নিয়ে যায়। নেগেটিভ ওয়ার্ডে যতদিন ছিলাম ততদিন প্রান্তিক দুইবেলা করে দূর থেকে ইনসুলিন দিয়ে এবং নিয়ে যেত।

সন্ধ্যায় আমেনা আসলো। তাকে ভর্তির ব্যবস্থা করা হলো। ওয়ার্ড বয়রা তাকে আমাদের রুমে দিয়ে গেলো। তার শরীরও বেশী ভালো না। বিছানাপাতি বিছিয়ে গরম পানি দিয়ে সে গোসল করে শুয়ে পরলো। একটুপর রাতের খাবার দিয়ে গেলো। রাতের মেন্যুও ভালো। ভাত, সবজি, ডিম, বড় এক পিস রুই/ কাতল মাছের ঝোল সাথে ডাল। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ হলো কিন্তু আমার ফুসরত নেই, কারণ আব্বাকে একটু পর পর টয়লেট করাতে হচ্ছে। আব্বা কেমন যেনো উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেলো। এতবার টয়লেট হলে একজন ৬৮ বছরের মানুষের এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক।

হঠাৎ করে নার্সরা আসলো আব্বাকে নাভির কাছে রক্ত তরল রাখার ইনজেকশন পাশাপাশি এন্টিব্যাক্টেরিয়াল ইনজেকশন দিলো। মীমকেও নাভীর কাছে ইনজেকশন দিলো। আমাকে শুধু ওরাল স্যালাইন আর কিছু মেডিসিন দিয়ে গেলো। আমেনার এখনো ট্রিটম্যান্ট শুরু হয়নি। আগামীকাল থেকে শুরু হবে তার ট্রিটম্যান্ট।

আমরা লাইট অফ করে শুয়ে পরলাম। ওয়ার্ড গুলোর দুই পাশের দরজা এবং জানালা সব গ্লাসের এমনভাবে করা যেনো বাইরে থেকে দেখা যায়, পাশাপাশি দরজা কোনো লক সিস্টেম নেই। বারান্দায় সিসি ক্যামেরা বসানো। তারা জানালো সমস্যা নেই রাতে মনিটরিং করার জন্যই এই ব্যবস্থা। আমার দুই চোখ ভেঙ্গে ঘুম আসলো শরীর ভেঙ্গে চৌচির, গত ৪৮ ঘণ্টা ঘুম নেই। দুই চোখ ডিঙ্গিয়ে কোথায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছি এমন সময় আব্বা ডেকে উঠলেন -ইমরান টয়লেটে যাবো। আমি চোখ মেলে বিছানা থেকে ঝটপট নেমে গেলাম। (চলবে)

লেখক: ডিরেক্টর, ডেলটা হেলথ কেয়ার, যাত্রাবাড়ী লি.

কুয়েত মৈত্রী হসপিটাল থেকে লিখছি: করোনার সাথে বসবাস (পর্ব-২)

কুয়েত মৈত্রী হসপিটাল থেকে লিখছি : করোনার সাথে বসবাস (প্রথম পর্ব)

Share this news on:

সর্বশেষ

img
তোমায় পেয়ে আমরা আনন্দে আত্মহারা : অমিতাভ Nov 16, 2025
img
গাড়িতে আগুন ও ককটেল নিক্ষেপকারীকে গুলির নির্দেশ ডিএমপি কমিশনারের Nov 16, 2025
img
গাজীপুরে নতুন কমিশনার, ৬ জেলার এসপি বদলি Nov 16, 2025
img
মেহজাবীনের বিরুদ্ধে মামলা করা কে সেই আমিরুল! Nov 16, 2025
img
স্টারবাকস বয়কটের ডাক দিলেন মামদানি Nov 16, 2025
img
পুলিশের ঊর্ধ্বতন আরও ২৩ কর্মকর্তাকে বদলি Nov 16, 2025
img
বাংলাদেশ কী ভাবে চলবে তা স্থির করবে আগামী দিনের সংসদ সদস্যরা: মেজর হাফিজ Nov 16, 2025
img
৪৫ বাংলাদেশিসহ মালয়েশিয়ায় ১২৩ অভিবাসী শ্রমিক আটক Nov 16, 2025
img
অতিরিক্ত পরিশ্রম নয়, সুস্থতাই সাফল্য, বলছেন দীপিকা Nov 16, 2025
img
জামিন পেলেন অভিনেত্রী মেহজাবীন Nov 16, 2025
img
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আধুনিক প্রশিক্ষণ ও পেশাদারিত্ব বাড়ানোর আহ্বান সেনাপ্রধানের Nov 16, 2025
img
চাঁদপুরে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আটক Nov 16, 2025
আ.লীগ ইস্যুতে জাবি জিএসের কড়া হুশিয়ারি! | Nov 16, 2025
img
ওয়াশরুম ভিডিও ইস্যুতে বিতর্ক তুঙ্গে, মুখ খুললেন মিথিলা Nov 16, 2025
img
নভেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে এলো ১৮ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স Nov 16, 2025
img
হাসিনার রায় যাই হোক সেটা কার্যকর হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Nov 16, 2025
img
বিকিনি পরার কারণ ব্যাখ্যা করলেন মিথিলা Nov 16, 2025
ব্যবসার পার্টনার করার প্রতিশ্রুতি, শেষে আদালতের পরোয়ানার মুখে মেহজাবীন Nov 16, 2025
img
সরকার ইটভাটার বিরুদ্ধে আইন করে, কিন্তু বিকল্প তৈরি করে না: রিজওয়ানা Nov 16, 2025
বাংলাদেশ মাফিয়াতন্ত্র ও গুণ্ডামীতন্ত্রে পরিণত হয়েছে : সামান্তা শারমিন Nov 16, 2025