পদ্মাসেতুর ইতিকথা

বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ। বাংলার ইতিহাস রচনা করেছে বাংলার নদ-নদী। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে আমাদের সভ্যতা, ঘরবাড়ি, সংস্কৃতি। নদ-নদীর কারণেই বাংলাদেশ সুজলা, সুফলা ও শস্যশ্যামলা। কবিরা কল্পনা দিয়ে নদীকে নারীর সাথে তুলনা করেছেন। বাঙ্গালি আদর করে নদীকে সুন্দর সুন্দর নাম দিয়েছে। আবার রাগ করে তাকে গালি দিয়েছে।

বাংলাদেশের একটি প্রধান নদী পদ্মা। এই নদীর ধ্বংসলীলা দেখে বাঙ্গালি ক্রোধভরে তার নাম দিয়েছে কীর্তিনাশা। পদ্মা নদী নিয়ে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন “তবু তাহা ভুল জানি, রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙ্গে কীর্তিনাশা;/ তবু পদ্মার রূপ একুশ রত্নের চেয়ে আর ঢের গাঢ়-/ আরো ঢের প্রাণ তার, বেগ তার, ঢের জল, জল আরো”।

উন্নয়ন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাদেশ সরকার দেশের পূর্ব এলাকার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূর করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। ফলে এই রূপবতী, বেগবতী, সর্বনাশা পদ্মা নদীর উপর পদ্মাসেতু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। মূল সেতুরটেন্ডার প্রক্রিয়ার সময় বিশ্বব্যাংক প্রথম আপত্তি তোলে। বিশ্বব্যাংকের সাথে সরকারের টানাপোড়েন শুরু হয়।

পরবর্তীতে সুপারভিশন কনসালটেন্সি প্যাকেজের টেন্ডার মূল্যায়নে কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ব্যাংক মাঝপথে কাজ বন্ধ করে দেয়। পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে ঋণ প্রত্যাহার করে। বিষয়টি গণ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা পায়। গোয়বলসীয় কায়দায় সত্যকে আড়াল করে দুর্নীতির উপাখ্যান তৈরি করা হয়।

দেশের ভেতরে ও বাইরে যেন তাসের ঘর নাটকের মঞ্চায়নের আয়োজন সম্পন্ন করা হয়। কুশীলব হিসেবে কাজ পায় বিভিন্ন সংস্থায় পে-রোলে থাকা শিয়াল বুদ্ধিজীবীরা। তারা কোরাস গায়। টকশোতে ধুরন্ধর নিশি কুটমরা মনের মাধুরী মিশিয়ে চায়ের কাপে ঢেউ তোলে। দুর্নীতি দমন কমিশন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তারা মামলা তুলে নেয়। আরও পরে কানাডার আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। এভাবে অশুভ ও অন্যায় চক্রের পরাজয় ঘটে।

উপরের কথাগুলি বললাম একটি আকর্ষণীয় বই পাঠ করে। বইটির নাম ‘’পদ্মাসেতু : সততা ও আত্মবিশ্বাসের বিজয়”। লেখক মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯৮১ ব্যাচে সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় সফল হয়ে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস এর উইলিয়ামস কলেজ থেকে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি তার সফল কর্মজীবন শেষ করেন সরকারের সিনিয়র সচিব হিসেবে। সজ্জন, সৎ,ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বিরল কৃতিত্বের অধিকারী।

বইটি পাঠ করতে গিয়ে আমি একটু দ্বিধায় পড়েছি। এটি কোন শ্রেণির বই? বইটিতে তিনি পদ্মা সেতু নিয়ে বিশেষজ্ঞ আলোচনা করেছেন। আলোচনায় উঠে এসেছে দাতা সংস্থার অর্থায়নে নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পের পেছনে থাকা রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রসঙ্গ। আবার কারাগারের ডায়েরি একান্ত আত্মজৈবনিক। তবে আমি মনে করি বইটিতে বিভিন্ন রীতির একটি সুন্দর মিশ্রণ ঘটেছে ।

বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে “যার আত্মবিশ্বাস ও সাহসী সিদ্ধান্তে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মাসেতু আজ দৃশ্যমান পদ্মাসেতুর রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা”- কে। মুখবন্ধ লিখেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা। ড: মসিউর রহমান জীবনে গৌরবময় কৃতিত্বের অধিকারী। অর্থনীতি বিশ্লেষণে তাঁর পারঙ্গমতা প্রশ্নাতীত। তাঁকেও এই মিথ্যা ষড়যন্ত্রে জড়িত করা হয়েছিল।

এই বইটিতে পদ্মাসেতু বিষয়ে যে ভুল ব্যাখ্যা ছিল লেখক সেই বিষয়টিকে সহজ করে সঠিক তথ্য আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। বইটিতে অনেক গুলি অধ্যায় আছে। সেতুর পরামর্শক নিয়োগ, টেন্ডার আহ্বান, মূল্যায়ন, বিশ্বব্যাংকের আপত্তি, দুর্নীতির অভিযোগ, দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা, লেখকের কারাবরণ ও সসম্মানে মুক্তি।

লেখককে পরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এর মেয়াদ শেষে তিনি অবসরে যান। এই বইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে প্রফেসর ড: মোহান্মদ ইউনুসের ভূমিকা। ড: ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি রাখতে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেন। বলা হয় ইউনুসকে এমডি পদ থেকে সরালে পদ্মা সেতু হবে না।

স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের কারণে লেখক ও তার পরিবারকে সীমাহীন দু:খ ও কষ্ট পোহাতে হয়েছে। কারাগারের ডায়েরিতে তিনি তার অগ্নিপরীক্ষার কথা ছোটোগল্পের মতো বলেছেন। এই অংশের বর্ণনা পাঠকের চিত্তকে দ্রবীভূত করবে। এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে কারা নায়ক ও কারা খল নায়ক লেখক তা চমৎকার করে প্রকাশ করছেন।

কোনো সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে লেখককে ঝুঁকি নিতে হয়। ঘটনাগুলি সমকালীন। লেখক নিজে তাতে অংশগ্রহণকারী। সে কারণে সর্বত্র নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে সত্য কথা বলা ও প্রকাশ করার সাহস লেখকের আছে। বইটি প্রকাশ করে তিনি একটি মিথ্যার রূপকল্পকে ভেঙ্গে দিয়েছেন। একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। পদ্মা সেতুর অলোচনা ও ব্যাখ্যায় তিনি একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। তাঁর আলোচনা নির্মোহ। তথ্য সংগ্রহ ও বিচার বিশ্লেষণের পদ্ধতি বইটিকে একটি মূল্যবান আকর গ্রন্থের মর্যাদায় উন্নীত করেছে।

লেখক সহজ ভাষায় এই সুখপাঠ্য গ্রন্থটি রচনা করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ে উৎসাহী সাধারণ পাঠক, উন্নয়ন কর্মী, নীতি- নির্ধারক, গবেষক ও সিভিল সার্ভিসের সদস্যসহ সকলের কাছে বইটি সমাদৃত হবে হলে আমি মনে করি। বইটির প্রকাশক বাংলা বাজারের বিদ্যাপ্রকাশের অধিকারী মজিবর রহমান খোকা।

উপসংহারে বিশ্বব্যাংকের বিতর্কিত অবস্থান নিয়ে একটি গল্প বলি। ইংরেজ কবিদের মধ্যে বায়রন ছিলেন খুব বিখ্যাত। তার বউকে তিনি সবসময় জ্বালাতন করতেন। গ্রীকের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি মারা যান। এই মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাঁর স্ত্রী বিস্ময়ের সাথে বললেন “ I really cannot determine whether he was or was not an actor”।

পদ্মা সেতুর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা অভিনয়, অভিনয় নয় কী? এই বইটি পড়ে বাংলাদেশের মানুষ দেশি- বিদেশি অভিনয়ের স্বরূপ বুঝতে পারবেন।

লেখক: সাবেক সচিব

Share this news on:

সর্বশেষ

img
চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সিদ্ধান্ত আগামীকাল বুধবার: নৌ উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
শাহজালাল বিমানবন্দরে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা, স্ক্যানিংয়ে কড়াকড়ি Jul 01, 2025
আসছে জুলাই ঘোষণা: স্থগিত হতে পারে সংবিধান, সরকারে রথবদলের ইঙ্গিত Jul 01, 2025
img
চট্টগ্রামের সাবেক ডিআইজিসহ আরও ৩ পুলিশ কর্মকর্তা বরখাস্ত Jul 01, 2025
img
ইরাকের উত্তরাঞ্চলে কিরকুক বিমানবন্দরে রকেট হামলা Jul 01, 2025
img
অভিনয় থেকে দুই মাস দূরে থাকবেন জোভান Jul 01, 2025
img
নির্বাচনী বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে কার্পণ্য করা হবে না: অর্থ উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
শিগগিরই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করতে যাচ্ছে ইরান: আব্বাস আরাঘচি Jul 01, 2025
‘আমরা একদলীয় দেশের বাসিন্দা’: ইলন মাস্ক Jul 01, 2025
img
উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করল ফ্রান্স Jul 01, 2025
img
সব আওয়ামী লীগারেরাই মেন্টালি সিক, তাদের থেরাপি ও রিহ্যাবে পাঠানোর পরামর্শ পিনাকির Jul 01, 2025
img
সবচেয়ে বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হজ আয়োজন ২০২৫ সালে Jul 01, 2025
img
জুনে রেমিট্যান্সে রেকর্ড, ২৯ দিনেই এসেছে ২৭০ কোটি ডলার Jul 01, 2025
img
'সৌদি আরবই এখন আমার ঠিকানা' Jul 01, 2025
img
শাকিব খানের ‘মেগাস্টার’ ট্যাগ নিয়ে তোপের মুখে জাহিদ হাসান Jul 01, 2025
img
পুরো অর্থনীতিই এখন মব এবং মামলার বাণিজ্যের মধ্যে ঢুকে গেছে : গোলাম মাওলা রনি Jul 01, 2025
img
১টি ত্রিপল, ৩টি সেঞ্চুরি - এক ইনিংসে ৮২০ রানের কীর্তি Jul 01, 2025
img
‘বজরঙ্গী ভাইজান’-এ অভিনয় করে কত টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন সেই মুন্নি! Jul 01, 2025
img
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নবনির্বাচিত কমিটির আত্মপ্রকাশ Jul 01, 2025
img
'ফুটবলের প্রতি যে ভালোবাসা এখনও আমার ভিতরে আছে তা আমাকে চালিয়ে নিচ্ছে' Jul 01, 2025