মেজর সিনহাকে নিয়ে যা বললেন তার মা

‘এই দেশ আর দেশের মানুষই সমস্ত ভাবনার বিষয় ছিল সিনহার। বিশেষ করে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে ভাবতো সে। এর অংশ হিসেবে সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে ডকুমেন্টারি নির্মাণ করছিল। বলতো আম্মু, মৃত্যুর আগে ভালো কিছু রেখে যেতে চাই পৃথিবীতে, যাতে মানুষ উপকৃত হয়।’

টেকনাফে পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে নিয়ে কথাগুলো বলেছেন তার মা নাসিমা আক্তার। সোমবার সকালে রাজধানীর উত্তরার বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব কথা বলেন তিনি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় সন্তানকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন তিনি। এসময় তিনি নিহত সিনহার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে তার কি পরিকল্পনা ও ভাবনা ছিল তা তুলে ধরেন।

অশ্রুসিক্ত নয়নে মা নাসিমা আক্তার বলেন, আমার ছেলে সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সবাইকে সে আপন করে ভাবতো, আপন করে দেখতো। প্রত্যেকটা মানুষকে- উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কাউকেই সে যে একজন মেজর এই পরিচয় দিয়ে কিছু করতো না। তার ব্যবহার দিয়ে সে কাজ করতো।

নাসিমা আক্তার বলেন, সিনহা বলতো মানুষের মানবিক যে গুনাবলি থাকে সেটা দিয়ে যদি মানুষ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে, এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে।

তিনি বলেন, আমি তাকে বলতাম- বাবা তুমি যে আর্মি থেকে চলে আসছো, সেখানে এতগুলো কোর্স তাহলে কেন করলে? এখন তোমার কত প্রমোশন হতো, ভালো অবস্থান হতো তোমার। সে বলতো মাম্মি, 'পাওয়ার! পাওয়ার কি? পাওয়ার আজ আছে কাল নেই, মানুষে হৃদয়ের মধ্যে থাকব, কাজ করব। আর কাজের কথা মুখে বলার মতো কিছু নয়।

ছেলের চারিত্রিক বিষয়ে নাসিমা বলেন, কাজের কথা মুখে বলতো না সে। আমি বুঝতাম সে কথায় বিশ্বাসী ছিল না, কাজে বিশ্বাসী ছিল। যেমন বিশ্ব ভ্রমণ করা নিয়ে সে বলতো, এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা, এইটা নিয়ে কোনো পূর্ব পরিকল্পনা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ সে জানাতে চাইতো না। সারপ্রাইজ দেবে। কিছু উপহার দেবে দেশকে। নেক্সট জেনারেশনের কথা অনেক ভাবতো। বলতো আমরা যদি কিছু ভালো রেখে যাই পৃথিবীতে। এই দেশের সবাই কেবল নেগেটিভ জিনিস দেখে, এই দেশে কিচ্ছু হবে না। কেন?

ছেলের প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডে তার সমর্থন ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, আমি জানতাম, তার চরিত্র এই ধরনের। তার এসব বিষয়ে আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। আমি তাকে নিয়ে গর্ববোধ করতাম। ও যেটা করতো, আমার মনে হয় আমার চরিত্রের সঙ্গে তার চরিত্রের মিল আছে। আমাদের অন্য কোনো চাহিদা ছিল না। শুধু কাজ করতে চাইতো। সেই কাজে আমি কখনো বাধা দেইনি।

ছেলের বিয়ে প্রসঙ্গে মা বলেন, আমি বলতাম সবাই বিয়ে করে, তুমি করবে না? সে বলতো ওইসব ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই। কারণ আমি কাজের প্রয়োজনে যেসব জায়গায় যাব, পিছুটান থাকলে সেসব কাজ সঠিকভাবে করা যাবে না।

তিনি বলেন, ডকুমেন্টারিটা করতে গেল- এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতো না, ভাসাভাসা বলতো, সারপ্রাইজ দিতে চাইতো। এমন একটি কাজ করবে, যা ক্রিয়েটিভ কাজ সবাই সারপ্রাইজড হবে। আমি সারপ্রাইজড হবো।

নাসিমা আক্তার বলেন, আমি বলতাম, তুমি কী কাজ করো; আত্মীয়-স্বজনরা বলতো, 'সে কী কাজ করে কোনো টাকা-পয়সা তো আসে না।’ ও বলতো- ‘আমি আমার মনের খোরাকের জন্য কাজ করি। এটা দিয়ে মানুষ উপকৃত হবে। আমার যেটা ভালো লাগে আমি সেটা করব'। এসব কথা ছেলেকে বললে বলতো, 'টাকা পয়সার কথা আমি ভাবি না।'

তিনি বলেন, তাকে কাজের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সে বলতো-‘'এই যে ডকুমেন্টারি তৈরি করছি।' আমি বলি, 'তুমি তো সেটা বল না।' বলতো, 'এখনো বলার মতো কিছু হয়নি আম্মু। বলার মতো যখন হবে তখন বলব।'

ছেলের প্রতি তার শতভাগ আস্থা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, আমি বসে থাকি এই ভেবে যে আমার ছেলে কাজ করছে। সে যা করতে চাইতো আমি তা করতে দিতাম। আমাকে বলতো ‘আম্মু, এই দেশের বাবা-মায়েরা কেমন জানি, খালি সন্তান ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, আরে তোমাদের জন্য আমরা কেন বলির পাঠা হব।'

তিনি বলেন, সিনহা আমাকে বলতো, আচ্ছা, তোমরা বাবা-মায়েরা লোকের সামনে বলবা ছেলে ডাক্তার হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষা তো ভিন্ন। আমার সঙ্গে এ নিয়ে প্রায়ই ফান করতো।

তিনি বলেন, আমি বুঝাতাম- আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ তো আসলে এই রকম। বাইরের দেশের হলে ভিন্ন কথা। সেখানকার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা- সবই আছে। কিন্তু আমাদের এখানে তো তা নেই। এই কারণে এখানে আমাদের বাবা-মায়েদেরও সন্তানের এসব বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হয়।

আরও পড়ুন

মেজর সিনহার আরেক সহযোগী সিফাতের জামিন

সিনহা হত্যায় সাক্ষী হচ্ছেন স্ট্যামফোর্ড ভার্সিটির সিফাত-শিপ্রা!

মেজর সিনহার স্কুল বিতর্কের ভিডিও ভাইরাল!

সিনহা হত্যা : লিয়াকত-প্রদীপসহ ৩ আসামি ৭ দিনের রিমান্ডে

ওসি প্রদীপের বিপুল সম্পদের উৎস কি?

 

টাইমস/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
লক্ষ্মীপুরে আগুনে পুড়ল ১৫ দোকান Nov 07, 2025
img
শালিনির সহায়তা ছাড়া কিছুই সম্ভব হতো না: অজিত কুমার Nov 07, 2025
img
মা ন্যাওটা, সরল ভাষায় অনির্বাণের অনুভূতি প্রকাশ Nov 07, 2025
img
৭ নভেম্বর বিপ্লবের মহানায়কে পরিণত হন জিয়াউর রহমান: মির্জা ফখরুল Nov 07, 2025
img
ভোটার আইডি কার্ড বাতিল না করে সংশোধন করার নির্দেশ নির্বাচন কমিশনের Nov 07, 2025
img
ক্যারিয়ারের জন্য পরিবারকে কখনো ত্যাগ করতে চান না শ্বেতা ভট্টাচার্য Nov 07, 2025
img
মার্টিনেজকে বাদ দিয়েই আর্জেন্টিনার দল ঘোষণা Nov 07, 2025
img
সরাইলে ট্রাক ও অটোরিকশার সংঘর্ষে প্রাণ গেল ২ জনের Nov 07, 2025
img
ট্রাম্পের সম্ভাব্য ভারত সফর হতে পারে আগামী বছর Nov 07, 2025
img
রেকর্ড শাটডাউনে অচল যুক্তরাষ্ট্র, বাতিল হাজারো ফ্লাইট Nov 07, 2025
img
সরকার না পারলেও বিএনপি নির্বাচনের আবহ তৈরি করতে পেরেছে : জিল্লুর রহমান Nov 07, 2025
img
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যেই করুক ছাড় দেবে না পুলিশ: ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি Nov 07, 2025
img
বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ফ্রান্সের স্কোয়াড ঘোষণা, নেই তিন তারকা Nov 07, 2025
img
বাংলা ধারাবাহিকের ভিত্তি পার্শ্বচরিত্র : সুব্রত গুহরায় Nov 07, 2025
img
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ১১ কোটি ডলারের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান হবে ৭৬০৭ জনের Nov 07, 2025
img
টলিউডে টিকে থাকতে মাটির পা জরুরি : সন্দীপ্তা সেন Nov 07, 2025
img
দেশের দুই বিভাগে বজ্রসহ বৃষ্টির পূর্বাভাস Nov 07, 2025
img
ফিফার বর্ষসেরা হওয়ার দৌড়ে ১১ জন, মেসি ও রোনালদো ভিন্ন তালিকায় Nov 07, 2025
img
সম্পর্ক মানে শর্ত নয়, বোঝাপড়া : অপরাজিতা আঢ্য Nov 07, 2025
img
ডিএসইর বাজার মূলধন হারাল আরও ৮৬৩২ কোটি টাকা Nov 07, 2025