ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের নেতা হিসেবে দেখতে চায় রাশিয়া ও চীন!

বিশ্ব যখন এক অস্থির যুদ্ধাবস্থার দ্বারপ্রান্তে— পূর্বে জ্বলছে আগুন, পশ্চিমে ছড়াচ্ছে বারুদের গন্ধ— ঠিক সেই সময় মধ্যপ্রাচ্যে দৃপ্ত পদক্ষেপে সামনে আসছে একটি পরাশক্তি: ইরান। যাকে রুখতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল, তবে একটিমাত্র ভুল হিসাব বদলে দিতে পারে গোটা বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্য।

যেখানে একসময় ইরান ছিল ‘অবরুদ্ধ রাষ্ট্র’ নামে পরিচিত, আজ তা ছায়ার আড়ালে গড়ে ওঠা এক পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে রূপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের হাতে এমন সামরিক, কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা রয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতেও একটি নতুন শক্তির কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে।

পারস্য উপসাগরে টহল দিচ্ছে ইরানের অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ, আকাশে উড়ছে এআই চালিত ড্রোন, আর স্যাটেলাইট থেকে নজরদারি করা হচ্ছে প্রতিটি কৌশলগত চলাচলের ওপর। পশ্চিমা বিশ্ব যখন ভেবেছিল ইরান পিছু হটবে, তখনই তেহরান গড়ে তুলেছে এমন এক সামরিক পরিকাঠামো যা এখন গোটা অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করছে।

ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর তেহরান বুঝে গিয়েছিল—বেঁচে থাকতে হলে পাল্টাতে হবে কৌশল। চার দশক পর সেই রূপান্তর এখন বাস্তব। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তারা ৮৩.৭ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম, যা পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার একেবারে কাছাকাছি।

এমন পরিস্থিতিতে ইরান যে কোন মুহূর্তে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে—এমনটাই মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। ইরানের স্থলবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিউমারস হেইদারী বলেছেন, ইরানের সেনাবাহিনী এখন আগের মতো ধীরগতির নয়, বরং আধুনিক ও দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল। সীমান্তে মোতায়ন রয়েছে ১০টি বিশেষ সামরিক ইউনিট, যাদের হাতে রয়েছে উন্নত ক্যামেরা, ড্রোন ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তি। ত্রিমাত্রিক নজরদারি ছাড়াও যুদ্ধক্ষেত্রে সেনারা এখন নিজে থেকেই শত্রু চিহ্নিত করে কৌশল সাজাতে এবং তাৎক্ষণিক হামলা চালাতে সক্ষম।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়, ইরানের সামরিক ব্যবস্থায় এখন প্রবেশ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তাদের কাছে এমন কিছু গোপন অস্ত্র রয়েছে, যেগুলোর বাইরের গঠন সাধারণ হলেও ভেতরে রয়েছে এআই প্রযুক্তি—যা শত্রুকে শনাক্ত করে স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।

এছাড়া সাইবার যুদ্ধেও প্রস্তুত ইরান। গঠন করা হয়েছে আলাদা সাইবার ইউনিট, যারা প্রতিপক্ষের সামরিক নেটওয়ার্ক, কম্পিউটার সিস্টেম কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ডেটা হ্যাক করতে সক্ষম। অর্থাৎ, ইরান এখন একযোগে মাটিতে ও ভার্চুয়াল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।
সম্প্রতি উন্মোচন করা হয়েছে ১১৬ নট গতির ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ “শহীদ সোলায়মানী” ও “শহীদ বাঘেরি”। এই সব উন্নয়নের মাধ্যমে ইরান স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে—তারা আর শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাস্তবে রূপান্তর ঘটাচ্ছে নিজের সামরিক সক্ষমতা।

এই বাস্তবতায় ওয়াশিংটন ও তেল আবিব চরম উদ্বিগ্ন। পশ্চিমা গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও আন্তর্জাতিক সংস্থা IAEA এখনও নিশ্চিতভাবে বলতে পারেনি, ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করছে কিনা।
এই উত্তেজনার মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে—ইরানের এই শক্তির প্রকাশ কি আত্মরক্ষার জন্য, নাকি পরবর্তী বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য? ইরান সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা কেবল আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে—যদি কেউ আঘাত করে, তবে তারা পাল্টা জবাব দিতে প্রস্তুত।

এখানেই এসে যুক্ত হচ্ছে রাশিয়া ও চীনের ভূমিকাও। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দুই পরাশক্তি চায়, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান হোক এবং ইরান হয়ে উঠুক বিকল্প নেতৃত্ব। রাশিয়া ও চীনের এই সমর্থন ইরানকে কেবল সামরিক নয়, কূটনৈতিক দিক থেকেও অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে।

এককালে যাকে বলা হতো অবরুদ্ধ, সেই ইরান আজ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম পরাশক্তি। ছায়া থেকে উঠে এসে আজ সে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ব রাজনীতির এক নতুন মেরুকরণের কেন্দ্রবিন্দুতে—আর রাশিয়া ও চীন স্পষ্টভাবে চাইছে, এই নেতৃত্ব এবার ইরানের হাতেই উঠুক।

আরএ/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ভূমিকম্পে মেট্রোরেলের ৬ স্টেশনে ফাটল Nov 22, 2025
img
গণভোট আগে হোক বা অন্যান্য ভোটের সঙ্গে একই দিনে হোক, উদ্দেশ্য একই: জোনায়েদ সাকি Nov 22, 2025
img
বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত, উচ্চ ঝুঁকিতে ঢাকা Nov 22, 2025
img
আলেমদেরকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে: ধর্ম উপদেষ্টা Nov 22, 2025
img
ডাকসু সদস্য রাফিয়ার বাড়িতে ককটেল হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তা‌র ৪ Nov 22, 2025
img
পোল্যান্ডে সেনা মোতায়েন নেদারল্যান্ডসের Nov 21, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে নাহিদের সৌজন্য সাক্ষাৎ Nov 21, 2025
img
রাজধানীতে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে আগুন Nov 21, 2025
img
'আমরা কখনো না কখনো কাউকে না কাউকে নিজেদের মনে ভালো জায়গায় বসাই' Nov 21, 2025
img
সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জামায়াত আমিরের অংশগ্রহণ Nov 21, 2025
img
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানদের সাক্ষাৎ Nov 21, 2025
img
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কড়া বার্তা Nov 21, 2025
img
ভালো করতে পারেননি তাসকিন, হেরেছে তার দল নর্দার্ন ওয়ারিয়র্স Nov 21, 2025
img
নিউমার্কেটে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ Nov 21, 2025
img
বন্দর রক্ষায় কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি Nov 21, 2025
img
বিএনপিতে কোনো নেতৃত্বের সংকট নেই : মনিরুল হক চৌধুরী Nov 21, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Nov 21, 2025
নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের পথে যাত্রা: প্রধান উপদেষ্টা Nov 21, 2025
img
বিশ্ব বাজারে ফের কমল স্বর্ণের দাম Nov 21, 2025
img
হাসিনা সরকার জনগণকে ভোটের সুযোগ না দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে : শামীম সাঈদী Nov 21, 2025