ইরান-ইসরায়েলও ছিল একসময়ের চরম বন্ধু। কিন্তু হঠাৎ কী এমন হল তাদের মাঝে? কীভাবে ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে হয়ে গেলেন একে অপরের চরম শত্রু? এক সময়ের সেই দুই বন্ধুর সম্পর্কই এখন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম উত্তেজনাপূর্ণ ও জটিল বিষয়।
তেলআবিব-তেহরানের বর্তমানের শত্রুতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস। একসময় ১৯২৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্ক ছিল চরম বন্ধুত্বপূর্ণ। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর ইরান দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে দেশটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। সেই সময় ফিলিস্তিনের অধিকাংশ ভূখণ্ডে জায়নিস্ট মিলিশিয়া জনসংখ্যাকে উৎখাত করে, যা ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় হিসেবে স্মরণ করে।
দখলদার দেশটি ‘পেরিফেরি নীতির' অংশ হিসেবে আরব দেশগুলোর বাইরের রাষ্ট্র যেমন ইরান, তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর হয়। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের গোপন পুলিশ সাভাক গঠনে সাহায্য করে এবং অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতাও বৃদ্ধি করে।
তবে ১৯৫১ সালে মোহাম্মদ মোসাদ্দেক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তেলশিল্প জাতীয়করণ ও পশ্চিমা শক্তির বিরোধিতা শুরু করায় ইরান তেলআবিবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। মোসাদ্দেকের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি ও আরব বিশ্বে সমর্থন অর্জন। ১৯৫৩ সালে মোসাদ্দেক সরকার পতনের পর শাহের পুনরায় ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে তাদের সম্পর্ক আবারও পুনরুজ্জীবিত হয়।
১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ইসলামি আদর্শের অধীনে ইসরায়েলকে ‘ছোট শয়তান’ ও যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বড় শয়তান’ ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ইরান সব ধরনের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ইসরায়েলের সঙ্গে ছিন্ন করে দেয় এবং ফিলিস্তিন ইস্যুকে আরব জাতীয়তাবাদের থেকে ইসলামিক ইস্যুতে রূপান্তরিত করে। ইরান তখন থেকে ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠী যেমন হিজবুল্লাহ ও হামাসকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সমর্থন দেয়।
এদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে তীব্র শত্রু আরব দেশগুলো এখন অনেকটাই সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান ও কুয়েতসহ অনেক দেশ ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। যাতে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক মানচিত্র দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, যেখানে একসময়কার শত্রু এখন মিত্রে পরিণত হচ্ছে, আর একসময়কার বন্ধু হয়ে উঠছে চিরশত্রু।
ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের ইতিহাস রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও কৌশলগত বহুবিধ কারণের মিশেলে গড়া। আজকের সংঘাতের পেছনে রয়েছে পুরনো ঘাত-প্রতিঘাত ও ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের জটিল অধ্যায়, যা মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
টিকে/টিএ