বিদেশি ঋণ ফের ১০৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের দায় আবারও ১০৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঋণের পরিমাণ এই সীমা ছাড়িয়ে যায়। ডিসেম্বর মাসে সামান্য কমলেও চলতি বছরের মার্চে আবারও ঋণের বোঝা ১০৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের প্রতিশ্রুত ঋণ আসছে।

কিন্তু ঋণের পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি যথাযথভাবে ব্যয় নিশ্চিত করা জরুরি। তা না হলে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে।

সরকার প্রতিবছর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বাজেট ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করে। তবে বিগত ১৫ বছর ধরে উচ্চাভিলাষী বাজেট বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার।

পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না আসায় বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর পাশাপাশি দুর্নীতি, অর্থপাচার ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে বলে অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘মার্চে মাত্র এক বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আগের প্রতিশ্রুত ঋণ পরিশোধের অংশ। এসব ঋণ নির্ধারিত খাতে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো তা ব্যবহার করছে।

সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করে অন্তর্বর্তী সরকার, যার মধ্যে সরকারের সরাসরি দায় ছিল প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার এবং আদানি বিদ্যুৎ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র ও পায়রা বন্দরের কয়লা আমদানির বিপরীতে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার শোধ করা হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধ সত্ত্বেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কোনো চাপ পড়েনি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আগের সরকারের সময় ডলার সংকট চরমে পৌঁছালে তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ঋণ পরিশোধের সময় বারবার বাড়িয়ে দেন। তখন রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ করে দায় মেটানো হতো। ফলে দেশের রিজার্ভ ভয়াবহভাবে কমে যায়।

বর্তমানে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ করে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে ডলার সরবরাহের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণ করায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ে। ফলে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করেও রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার কার্যকর করায় ডলারের দাম কমতে শুরু করে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতির হারেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বিভিন্ন উৎস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে ৬.৯২ বিলিয়ন ডলার যোগ হয়। বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরও নিট ২.৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভে জমা হয়। এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে প্রায় ১.৫০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বিগত সরকারের সময় নেওয়া বড় বড় মেগাপ্রকল্প ও বাজেট সহায়তার ঋণের গ্রস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় বর্তমান সরকারের ওপর বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। একই সঙ্গে বাজারভিত্তিক উচ্চ সুদহারের বিভিন্ন ঋণ গ্রহণও এতে প্রভাব ফেলেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে অর্থনীতিবিদরাও বিদেশি ঋণ গ্রহণের বিষয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তবে তাঁদের পরামর্শ উপেক্ষা করেই শেখ হাসিনার সরকার বিদেশি উৎস থেকে ঋণ বাড়িয়েছিল। শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সাড়ে ১৫ বছরে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেন আট হাজার ৬২ কোটি (৮০.৬২ বিলিয়ন) ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৮ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২.৭৯ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। পরের পাঁচ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ৩৯ শতাংশ। এতে ২০১৩ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৩১.৭৯ বিলিয়ন ডলার।

২০১৪ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এর পরের পাঁচ বছরে (২০১৪-১৮ সাল) দ্রুত বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায়। ওই পাঁচ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ৭৯.৫১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ৫৭.০৭ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের পাঁচ বছরে (২০১৯-২৩) বৈদেশিক ঋণ বাড়ে সবচেয়ে বেশি। ওই সময় বিদেশি ঋণ বাড়ে ৭৬ শতাংশের বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ১০০.৬৪ বিলিয়ন ডলার। চতুর্থ ধাপে ক্ষমতার ছয় মাসে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয় প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। পতনের সময় শেখ হাসিনা বিদেশি ঋণ রেখে যান ১০৩.৪১ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান সরকারের ৯ মাসে বিদেশি ঋণ তেমন বাড়েনি। চলতি বছরের মার্চ শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১০৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার। ৯ মাসে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ বেড়েছে।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘১০৪ বিলিয়ন হোক বা অন্য যেকোনো সংখ্যা। মূল প্রশ্ন হলো, ঋণের অর্থ সঠিক খাতে ব্যবহার হচ্ছে কি না এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা উৎপাদনে যাচ্ছে কি না। না হলে এই ঋণ ভবিষ্যতে জাতীয় বোঝায় পরিণত হবে।’

তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, প্রথম ইউনিট থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদনের কথা ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু তা হয়নি। এখন প্রথম ইউনিট থেকে উৎপাদনের সম্ভাব্য সময় ধরা হচ্ছে ২০২৬ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিটের জন্য ২০২৭ সাল।

অথচ এই প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের সময় এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। যদিও সরকার ঋণ শোধে অতিরিক্ত ১৮ মাস সময় নিয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি ঋণের অর্থের সঠিক ব্যবহারে প্রশ্ন তুলছে।

তিনি বলেন, আগের সরকারের সময় ঋণ নেওয়া হয়েছে বলেই বর্তমান সরকার দায় এড়াতে পারে না। কারণ প্রশাসনের যন্ত্রে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এখনো রয়েছেন। সেখানকার সংস্কার ছাড়া সিস্টেমিক ব্যর্থতা দূর হবে না।


পিএ/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ফ্রান্সে প্রতি ১০ মুসলিমের ৮ জনই বৈষম্য-বিদ্বেষের মুখোমুখি : জরিপ Sep 17, 2025
img
চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়ালের হয়ে ইতিহাস গড়লেন আর্জেন্টাইন মাস্তানতুয়োনো Sep 17, 2025
img
শাহরুখ খান শুধু অভিনয়ে নয়, মেধাতেও ছিলেন সেরা! Sep 17, 2025
img
চাকসু নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় বাড়ল Sep 17, 2025
img
মোহাম্মদ ইউসুফকে ধুয়ে দিলেন ভারতের সাবেক অলরাউন্ডার মদন লাল Sep 17, 2025
img
কেন চার্লি কার্ককে খুন, প্রেমিকাকে গোপন বার্তায় জানালেন অভিযুক্ত রবিনসন Sep 17, 2025
img
প্লট বরাদ্দ দুর্নীতিতে পরিবারসহ হাসিনার বিরুদ্ধে ৩ মামলায় ৫ জনের সাক্ষ্য Sep 17, 2025
img
ভারতের উত্তরাখণ্ডে মেঘভাঙা বর্ষণে প্রাণ গেল ১৫ জনের Sep 17, 2025
img

জেরায় স্টেট ডিফেন্স আইনজীবীর দাবি

শেখ হাসিনার আমলে কোনো দুর্নীতি-হত্যাকাণ্ড ঘটেনি Sep 17, 2025
img
বিরূপ মনোভাব থাকায় সাক্ষ্য দেন মাহমুদুর রহমান: শেখ হাসিনার আইনজীবী Sep 17, 2025
img
সব প্রকল্পের টেন্ডার অনলাইনে হবে: পরিকল্পনা উপদেষ্টা Sep 17, 2025
img
ভারতে সেনাবাহিনীর মতো ইউনিফর্ম পরে ব্যাংক থেকে ২০ কোটি রুপির স্বর্ণ লুট Sep 17, 2025
img
৪০ বছরে ব্রাজিল দলে ফিরতে পারেন সিলভা, ইঙ্গিত আনচেলত্তির Sep 17, 2025
img
কাউকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার : তাবিথ আউয়াল Sep 17, 2025
img
প্রথমবার টি-টোয়েন্টি সিরিজে মাঠে নামছে ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড Sep 17, 2025
img
ছবির ট্রেলারে দেখা মিলল হাসিনার! মৈত্রীর বার্তা দিলেন পরিচালক Sep 17, 2025
img
প্লট জালিয়াতি মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ ৩০ সেপ্টেম্বর Sep 17, 2025
img
রাজধানীর সাতরাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক Sep 17, 2025
img
জামায়াত নেতার পদ স্থগিত Sep 17, 2025
img
নির্বাচনে অনীহা থেকেই তাদের কর্মসূচি : আমীর খসরু Sep 17, 2025