ডায়াবেটিস প্রতিরোধী ‘কেওড়া’ফলের অনেক গুন!

বাহারি হাজার ফলের ভিড়ে একটি অতি সাধারণ বুনো ফলের নাম ‘কেওড়া’। ফলটি কেমন-তা উপকূলীয় এলাকার অনেকে জানলেও শহুরে লোকদের কাছে এটি একেবারেই অপরিচিত। অথচ এ ফলটি হতে পারে আপনার খাদ্য তালিকার অন্যতম অনুষঙ্গ। দিতে পারে পুষ্টির যোগান। এমনকী ডায়াবেটিসসহ অনেক মারাত্মক রোগ প্রতিরোধেও টনিকের মত কাজ করে কেওড়া।  

সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার গবেষণায় দেখিয়েছেন এ ফলটি মানব দেহের জন্য খুবই উপকারী। এ ফলটিকে খাদ্য তালিকায় আনতে এর ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন বলেও মনে করেন এ গবেষক।

খুবির বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ জুলফিকার হোসেনের গবেষণার ওই ফলাফল দেশি-বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হলে সম্প্রতি কেওড়ার পুষ্টিগুণের বিষয়টি আলোচনায় আসে।  

গবেষণাকর্মের ভূমিকায় অধ্যাপক জুলফিকার হোসেন জানান, কেওড়া গাছ সুন্দরবনে প্রচুর পরিমাণে জন্মে। তাছাড়া উপকূলীয় এলাকায় নতুন সৃষ্ট চরে এ ম্যানগ্রোভ গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে। লবণাক্ততা সহিষ্ণু এ গাছে প্রচুর ফল হয়, যা কেওড়া ফল নামে পরিচিত। সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জেলার লোকজন কেওড়া ফলের সঙ্গে ছোট চিংড়ি ও মশুরের ডাল রান্না করে খেয়ে থাকে। তাছাড়া, কেওড়া ফল হতে আচার ও চাটনি তৈরি করা হয়। এ ফল পেটের অসুখের চিকিৎসায় বিশেষত বদহজমে ব্যবহৃত হয়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সেল কর্তৃক প্রদত্ত গবেষণা অনুদানের অর্থে অধ্যাপক শেখ জুলফিকার হোসেনের গবেষণালব্ধ প্রকাশিত ফলে দেখা যায়, কেওড়া ফলে রয়েছে প্রায় ১২% শর্করা, ৪% আমিষ, ১.৫% ফ্যাট, প্রচুর ভিটামিন বিশেষত, ভিটামিন সি এবং এর ডেরিভেটিভগুলো। কেওড়া ফল পলিফেনল, ফ্লাভানয়েড, অ্যান্থোসায়ানিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও আনস্যাচুরেটেড ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড বিশেষ করে লিনোলেয়িক অ্যাসিডে পরিপূর্ণ।

এ কারণে মনে করা হয়, ফলটি শরীর ও মনকে সতেজ রাখার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কার্যকরী। চা-এর মতো এ ফলটিতে ক্যাটেকিনসহ বিভিন্ন ধরনের পলিফেনল প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। এদেশে প্রাপ্ত ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলিফেনল রয়েছে আমলকীতে, তারপরই হলো কেওড়া ফলের অবস্থান। কেওড়া ফলে সমপরিমাণ আপেল ও কমলা ফলের তুলনায় অনেক বেশি পলিফেনল ও পুষ্টি উপাদান রয়েছে। পলিফেনল শরীরে ডায়াবেটিস, ক্যানসার, আথ্রাইটিস, হৃদরোগ, অ্যালার্জি, চোখের ছানি, বিভিন্ন ধরনের প্রদাহসহ প্রভৃতি রোগ সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করে।

কেওড়া ফলে আমলকী, আপেল ও কমলা ফলের তুলনায় বেশি পরিমাণ পটাশিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম ও জিংক রয়েছে। এ ফলের রয়েছে ডায়রিয়া ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধী এবং ব্যথানাশক গুণাগুণ। ফলটি ডায়রিয়া, আমাশয় ও পেটের পীড়ার জন্যে দায়ী ব্যাক্টেরিয়াকে কার্যকরীভাবে দমন করতে পারে। তাছাড়া, কেওড়া ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ পালমিটিক অ্যাসিড, অ্যাস্করবাইল পালমিটেট ও স্টিয়ারিক অ্যাসিড, যা খাদ্যশিল্পে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে এবং তৈরি খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহূত হয়।

তাই উপকূলীয় এলাকার অনাবাদি লবণাক্ত জমিতে ফলটি ব্যাপকভাবে জন্মানোর উদ্যোগ নিলে প্রান্তিক জনগণের বাড়তি আয়ের উৎস হবে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে এবং উপকূলীয় পরিবেশের গুণগত মানের উন্নয়ন হবে বলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ জুলফিকার হোসেন মনে করেন।

এ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলো অরিয়েন্টাল ফার্মাসি অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিন ২০১৩, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফুড প্রোপার্টিজ ২০১৬ এবং প্রিভেনটিভ নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্স ২০১৭ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

কেবল সুন্দরবন এলাকায় নয়, উপকূলীয় যে কোনো এলাকায় জন্মে কেওড়া গাছ। নদীর তীরে কিংবা জলাশয়ের কাছে এ গাছ জন্মে। তাই উপকূলের ১৯টি জেলায় কমবেশি এ ফলের দেখা মেলে। কোনো কোনো এলাকায় কেওড়া ফলকে ‘ছৈলা’ নামেও ডাকা হয়।  

 

টাইমস/এমএস

 

Share this news on: