রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ ও অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণে নতুন অভিযানে সরকার

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের (এফডিএমএন) ক্যাম্পগুলোর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যা, অপহরণ, মাদক পাচার, চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসী তৎপরতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এতে ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে এবং এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে স্থানীয়দের জীবনযাত্রায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যৌথভাবে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এসব নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক অপরাধ দমনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশেষ করে ‘আরসা’ ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব ঠেকাতে কঠোর অভিযান চলবে। ক্যাম্পে নিয়মিত ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে যৌথ টহল জোরদার করা হবে। রোহিঙ্গাদের সশস্ত্রগোষ্ঠী ‘আরসা’র সন্ত্রাস ও গুজব রোধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে।

সভা সূত্র বলছে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ, মাদক পাচার ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে হত্যা, অপহরণ, অস্ত্র ও ইয়াবা চোরাচালান, চাঁদাবাজি এবং গুজব ছড়ানোর মতো অপরাধ বাড়ায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে স্থানীয় জনজীবনেও। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভাসানচর ও উপকূলীয় এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি সীমান্তে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এক গণমাধ্যমকে বলেন, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বাস করছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নারী ও শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে তারা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি চলছে। যে কারণে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের এটি অন্যতম কারণ। এ পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্রমবর্ধমান অপরাধ ঠেকাতে এখানে নিয়মিত ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ, বিজিবি, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। গুজব ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে ও হবে।

সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘আরসা’ ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব বেড়েছে বলে সভায় জানানো হয়। তারাই মাদক ব্যবসা, অস্ত্র চোরাচালান, চাঁদাবাজি ও অপহরণে জড়িত হচ্ছে। এসব গোষ্ঠী ক্যাম্পের ভেতর গুজব ছড়িয়েও রোহিঙ্গা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে বলে এমন তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে জানানো হয়েছে। জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথবাহিনী অভিযান পরিচালনা করছে বলে জানানো হয় সভায়।

সভা সূত্রে আরও জানা গেছে, ক্যাম্পের ভেতর শক্তিশালী চক্র সক্রিয়। তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি জটিল হবে। এজন্য গোয়েন্দা সংস্থা ও এপিবিএন সমন্বিতভাবে কাজ করছে।

তথ্য অনুযায়ী, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে এখন প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বাস করছে। মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সংঘাতের কারণে নতুন করে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও দুই লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে ক্যাম্পের ভেতরে অপরাধের পাশাপাশি স্থানীয় নিরাপত্তাও ঝুঁকিতে পড়ছে। ক্যাম্পে নারী ও শিশু যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, কিশোরদের একটি অংশ জড়িয়ে পড়ছে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানে। স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

সূত্র বলছে, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নোয়াখালী, সন্দ্বীপ ও হাতিয়াসহ উপকূলীয় অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে ভাসানচর কিংবা অন্যত্র যাতায়াত বন্ধে বিশেষ নজরদারি চালাবে কোস্ট গার্ড ও পুলিশ। একইসঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকদেরও নৌপথে যাতায়াত রোধে অভিযান চালানো হবে। ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারা যাতে পুনরায় কক্সবাজার বা অন্যত্র না যেতে পারে, সেজন্য বিশেষ টহল জারি থাকবে। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন, কোস্ট গার্ড এবং পুলিশ একযোগে কাজ করবে।

এদিকে, সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। বিজিবি ও কোস্ট গার্ডকে সীমান্তে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সীমান্তে টহলও জোরদার করা হয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত চলমান থাকায় নতুন করে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করতে চাইছে। সীমান্তে থাকা ফোর্সকে প্রতিহত করতে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় একাধিক সংস্থাকে কার্যকর ভূমিকা পালনের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশ অধিদপ্তর, বিজিবি, সরকারি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, এনজিও বিষয়ক ব্যুরো, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নোয়াখালী জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, আনসার ও ভিডিপি।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন এক গণমাধ্যমকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যৌথ টহল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গড়া যৌথবাহিনীর অভিযান জোরেশোরে চলছে। অভিযানে প্রায় ১৯ লাখ ইয়াবা পিস উদ্ধার হয়েছে। মামলা হয়েছে দেড় শতাধিক। তল্লাশিসহ অন্য অভিযানে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, নিরাপত্তা চৌকিতে কঠোর তল্লাশি ও নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। মাদকদ্রব্য চেকিংয়ের জন্য এখানে অত্যাধুনিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হবে। কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনে কেউ মাদকদ্রব্য বহন করছেন কি না সেজন্য যাত্রীদের যাচাইয়ে আধুনিক স্ক্যানার বসানো হয়েছে। তবে একদিকে আইন প্রয়োগ চলবে। পাশাপাশি মানবিক দৃষ্টিকোণ বজায় রাখাও নিশ্চিত করা হবে।

এমকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ঝোপে পোশাক পরিবর্তন ও দূরের টয়লেট নিয়ে কারিশমার কঠিন সময়ের স্মৃতিচারণ Aug 24, 2025
img
সরকারের আদেশটি অদ্ভুত ও হাস্যকর : মাসুদ কামাল Aug 24, 2025
img
কক্সবাজারে বাস-প্রাইভেটকার সংঘর্ষে ২ পর্যটক নিহত Aug 24, 2025
'অভ্যুত্থান হোক বা বিপ্লব, ১ বছর কেটে গেছে' Aug 24, 2025
img
অসুস্থতা কাটিয়ে ছুটি কাটাতে বিদেশে পরীমণি Aug 24, 2025
img
সিলেট-বান্দরবানের ১৭টি পাথর কোয়ারি ইকো-ট্যুরিজম হিসেবে সংরক্ষণের নির্দেশ Aug 24, 2025
img
তৌহিদ আফ্রিদি গ্রেপ্তার Aug 24, 2025
img
ওআইসি বৈঠকে যোগ দিতে সৌদি গেলেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী Aug 24, 2025
img
আগ‌স্টের ২৩ দিনে রেমিট্যান্স এলো ২১ হাজার কোটি টাকা Aug 24, 2025
img
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে জোর দিলেন প্রধান উপদেষ্টা Aug 24, 2025
img
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সিলেট স্ট্রাইকার্সের জিরো টলারেন্স ঘোষণা Aug 24, 2025
img
ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে অভিনয়ে থিতু হলেন তটিনী Aug 24, 2025
img
ভারতীয় সিনেমার লিজেন্ড মিঠুন চক্রবর্তীর অসাধারণ রেকর্ড Aug 24, 2025
img
আমরা বাংলাদেশকে শত্রু মনে করি না: ত্রিপুরার মন্ত্রী Aug 24, 2025
img
ঢাকায় ২৫টি স্থায়ী পোস্টার বোর্ড চালু করল ডিএনসিসি Aug 24, 2025
img
পকেট ভরার জন্য রাজনীতি করতে চাইলে বিএনপি থেকে বিদায় : এ্যানি Aug 24, 2025
img
এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকছে না সরকারের হাতে Aug 24, 2025
img
মুক্তি পেল আরিয়ান খানের 'বাদলি সি হাওয়া হ্যায়’ গান Aug 24, 2025
img
এক বছরের বিরতির পর কোক স্টুডিও বাংলায় ফিরল ‘বাজি’ Aug 24, 2025
img
ফিফা গেমে বাংলাদেশের নাম অর্ন্তভুক্ত করতে চায় বাফুফে Aug 24, 2025