যেভাবে মাত্র ৭ দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর করোনা জয়!

আসলে কতটুকু সচেতনতা আমাদেরকে জয় এনে দিতে পারে নভেল করোনা ভাইরাসের বিপক্ষে? ভয় না পেয়ে সচেতনতার সাথেইতো বাসায় ছিলাম, তবু কিভাবে আমি এবং আমার পরিবারের তিন সদস্য আক্রান্ত হই?

প্রশ্নের উত্তর এখনো খুজে বেড়াই আর ভাবি এর শেষ কোথায়...
গত মাসের ১৪ তারিখ আম্মুর হঠাৎ করেই জ্বর আসে। আম্মু বেশ হেসেই বলছিলো,
-"তাহা? এবার তো মনে হয় হয়েই গেলো। আমি চলে গেলে তোরা ভাই-বোনরা ঝগড়া করিস না।"
প্রথম প্রথম কথাটা অনেকটা হেসে উড়িয়ে দেই।

নভেল করোনা ভাইরাসতো আর বাসায় হেঁটে হেঁটে আসতে পারবে না। আসতে হলে তাকে মানুষের শরীরে ভর করেই আসতে হবে। আর সেই ভর করে আসার ব্যাপার টা কখনোই সম্ভব না কারণ আমি ও আমার পরিবারের কেউই লকডাউনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা ছাড়া বাইরে বের হইনি। আর বের হলেও কয়েক সপ্তাহ পর পর সম্পূর্ণ সুরক্ষা নিয়েই বের হতাম।

অন্য দিকে সময় টাও ছিলো সিজনাল ফ্লু এবং ভাইরাস জ্বরের। তাই মোটামুটি নিশ্চিন্তেই ছিলাম যে করোনা থেকে আমরা মুক্ত।
অন্য সবার মতো আমিও বিশ্বাস করতাম,
"আমার করোনা হবে না কারণ আমি সচেতন....."
সেদিন আম্মুর জ্বর একবার উঠে আবার চলে যায়। এরপর আবার ১৬-ই মে জ্বর আসে এবং পরদিন ১৭-ই মে আমার ছোট বোনেরও জ্বর আসে। সিজনাল ফ্লু/ ভাইরাস জ্বর ভেবে আম্মুর মন আর শান্ত থাকতে পারলো না তাই ১৮-ই মে একাই চলে যায় করোনা টেস্ট করাতে।

২০-ই মে সকাল বেলায় আমারও জ্বর আসে। রোজা ভেঙে দ্রুত নাপা খেয়ে নেই এবং সেদিন দুপুরে আম্মুর করোনা টেস্ট রেজাল্ট পজেটিভ আসে। মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই যে আমরা পরিবারের সকলেই নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত! হ্যাঁ... আমরাও সেই ভয়ংকর মহামারী থেকে মুক্ত নই যা গোটা পৃথিবীকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।

যেহেতু প্রাথমিকভাবে আমার ও আমার ছোট বোনের জ্বর আসার ধরন আম্মুর মতোই ছিলো তাই আমরা নিজেদের সাস্পেক্টেড করোনা আক্রান্ত হিসেবে ধরে নেই এবং আলাদা একটা রুমে বেডিং করে ফেলি। "করোনা রোগীরা কয়েকজন নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে পাশাপাশি থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে"- আমার ডাক্তার খালাতো ভাইয়ের এরূপ পরামর্শের ভিত্তিতেই আমি,আম্মু ও আমার ছোট বোন এক রুমে থাকার সিদ্ধান্ত নেই।

আর বাসায় যেহেতু তিন টি মাত্র বেড রুম তাই আমি, আমার মা ও আমার ছোট বোন একটা তে থেকে বাকি দুইটায় আলাদাভাবে আমার ভাই এবং আমার বাবা কে রাখি।

বলে রাখা ভালো যে, করোনা টেস্ট রেজাল্ট পজেটিভ আসার পর সরকার থেকে কোনো নির্দেশনাই আমাদের দেয়া হয়নি এক্সস্যাপ্ট দ্যাট ওয়ান "স্টে এ্যাট হোম" ম্যাসেজ।
এর পরের দিন অর্থাৎ মে মাসের ২১ তারিখে আমি, বাবা, ভাইয়া এবং ছোট বোন সাস্পেক্টেড করোনা রুগী থেকে শতভাগ নিশ্চিত হতে করোনা টেস্ট করাই এবং ২৩-ই মে'র রেজাল্টে ভাইয়া বাদে আমাদের সবার করোনা টেস্ট রেজাল্ট পজেটিভ আসে।

আর হ্যাঁ আমার বাবা একজন হার্টের রুগী এবং আমার মায়ের ডায়াবেটিস আছে এবং তাদের দুজনের বয়সই যথাক্রমে ষাটোর্ধ এবং পঞ্চাশোর্ধ। এইতো গেলো আক্রান্ত নিশ্চিত হওয়ার কথা।

এবার আসি কিভাবে জয় করলাম নভেল করোনা ভাইরাস...
আপনি যখন নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন তখন আপনাকে যে জিনিসটা তাড়া করে বেরাবে সেটা হলো, "আমি একজন রুগী। আমি মহামারী তে আক্রান্ত এবং সবার মতো আমার মৃত্যু হতে পারে।" তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই এমন চিন্তা যাতে আমার মাথায় না আসে ঠিক সেরকম ব্যবাস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১. প্রথমেই সমস্ত করোনাভাইরাস বিষয়ের খবর আমি এড়িয়ে যেতে থাকি।

২. আমি চাইনি কেউ আমাকে ফোন দিয়ে কেদে ফেলুক কিংবা বলুক "আল্লাহ তাহা তোমার করোনা হইছে?" কারণ আমি বিশ্বাস করতাম এতে করে আমার মনোবল দূর্বল হয়ে যাবে।
তাই অনেক কাছের বন্ধুবান্ধবকে আমার আক্রান্তের কথা জানাইনি কারণ কয়েকজন জানলে সবাই জেনে যাবে। সবার কান্না কিংবা ভয় পাওয়া কখনোই আমার কাম্য ছিলো না।
কখনোই কারো মাঝে প্যানিক সৃষ্টি কিংবা নিজেই প্যানিক করতে চাইনি।

৩. একটা রুমে বন্দি থেকে নিজেকে অস্বাভাবিক যাতে না মনে হয় সেরকম প্রত্যেকটি কাজই আমি করে যাই। ফেইসবুকে ছবি আপলোড,নিয়মিত বন্ধুদের সাথে কথা বলা, ঈদের দিন সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করা থেকে শুরু করে এমন কিছুই ছিলো না যে আমি বাদ দিয়েছি। যদিও প্রথম দুই দিন আম্মা ও ভাইয়া বেশ কান্নাকাটি করে কিন্তু এরপর থেকেই আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি যে আমাদের কিছু হয়নি এবং দ্রুতই আমরা ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে উঠবো।

৪. নিয়ম করে ওষুধ সেবন করতাম। নাপা এবং স্যালাইন ছিলো কমন ওষুধ । এছাড়াও আমাকে অ্যান্টিবায়োটিক আর আমার মাকে সিরাপ দেয়া হয়েছিল। সব সময় পরিস্কার থাকার চেষ্টা করেছি। যতটা পেরেছি ভিটামিন-সিযুক্ত খাবার খেয়েছি। গরম মসলা দিয়ে লেবু পানি দিনে তিন বার খেতাম। কাজের ফাঁকেই এক্সারসাইজ করে ফেলতাম। এবং অবশেষে মহান আল্লাহ'র দয়ায়, আত্মীয়-স্বজনের দোয়া এবং সেবায় আমরা দ্রুত সুস্থ্য হয়ে উঠি।
আমি ও আমার বোন আক্রান্ত হওয়ার ৭ দিনের মাথায় এবং আমার বাবা-মা আক্রান্তের ১৫ দিনের মাথায়ই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। গলা ব্যাথা, কাশি, জ্বর, ক্লান্তি ভাব ইত্যাদি ছাড়া তেমন কোনো ম্যাজর সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়নি। পুরোটা সময় জুড়ে আমরা একে অপরের সব থেকে বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছি।

মনে রাখা প্রয়োজন, "করোনা হলেই আপনাকে হাসাপাতালে যেতে হবে না আর করোনা মানেই আপনি মরে যাবেন না"। কাছের মানুষের সেরে ওঠার গল্প হয়তো আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে আর সে কথা ভেবেই আপনাদের সাথে শেয়ার করা। আমরা পেরেছি, আপনিও পারবেন। ইনশাআল্লাহ একদিন করোনাকে জয় করে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াবো, মেতে উঠবো বিজয় উল্লাসে। পৃথিবী আবার হাসবে।

ততদিন পর্যন্ত, "স্টে এ্যাট হোম, স্টে সেইফ এ্যান্ড স্টে স্ট্রং"।

দেখা হবে বিজয়ে!

মমতাজ তাহা
মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

টাইমস/জেকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
'আমি আটপৌরে শাড়িই পরি' Nov 22, 2025
img
এমন কাজ করব যেখানে অভিনেত্রী হিসাবে আমায় ব্যবহার করা হবে: মিমি Nov 22, 2025
img
সারা দেশে রাতে কমতে পারে তাপমাত্রা Nov 22, 2025
img
জাতীয় স্মৃতিসৌধে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন Nov 22, 2025
img
সমঝোতার আসনে আগ্রহী শরিক দল, নিজ প্রতীকে ভোট নিয়ে জটিলতায় বিএনপি! Nov 22, 2025
img
কাম্প ন্যুতে ফেরার ম্যাচে বার্সার জোড়া সুখবর Nov 22, 2025
img
আয়ারল্যান্ড সিরিজে টানা তৃতীয় হাফ সেঞ্চুরির দেখা পেলেন মুমিনুল Nov 22, 2025
img
নায়িকা মাহির পছন্দ ভাতের সঙ্গে শুঁটকি Nov 22, 2025
img
অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা, নিজস্ব দর্শন প্রকাশ জোজোর Nov 22, 2025
img
ঐশ্বর্যকে শাসন করার দায়িত্ব আমার নয়: জয়া বচ্চন Nov 22, 2025
img
চট্টগ্রামে ভূমিকম্পে ধসে পড়তে পারে ৭০-৮০ শতাংশ ভবন Nov 22, 2025
img
দ্বিতীয় টেস্টেও সেঞ্চুরির সুযোগ মিস করলেন সাদমান ইসলাম Nov 22, 2025
img
আর পেশাদার ফুটবলে ফিরছেন না ব্রাজিলিয়ান তারকা ফার্নান্দিনিয়ো Nov 22, 2025
img
ঢাকায় এসেই ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির খোঁজ নিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী Nov 22, 2025
img
ট্রাম্পের প্রস্তাবে হয় আত্মমর্যাদা হারাব, নয়তো আমেরিকাকে: জেলেনস্কি Nov 22, 2025
img

মির্জা ফখরুল

ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকবে বিএনপি Nov 22, 2025
img
পাকিস্তানে গ্লু তৈরির কারখানায় বিস্ফোরণ, নিহত ১৬ Nov 22, 2025
img
বাংলায় দ্বিতীয় সিনেমা হিটের পর বদলে গিয়েছিল ভাবনা: দেব Nov 22, 2025
img

গোলাম পরওয়ার

গোলাম পরওয়ার নির্বাচনে দুর্নীতিবাজদের লাল কার্ড Nov 22, 2025
img
ভালোবাসার তালায় লেখা ‘পরী-শাওন’ Nov 22, 2025