এক বছরের বেশি হয়ে গেল সৎমেয়ে মারিয়া হারিয়ে গিয়েছে। সৎমা অ্যান স্বপ্ন দেখলেন, কেউ যেন তার মেয়েকে খুন করছে, পুঁতে ফেলছে কোনো এক শস্যাগারে! সেই ভিত্তিতেই খোঁজ শুরু হলো মেয়ের। 'রেড বার্ন মার্ডার মিস্ট্রি' নাকি সমাধান হয়েছিল এভাবেই।
মারিয়া মার্টেন ১৮০১ সালের ২৪ জুলাই ইংল্যান্ডে সাফল্কের পোলস্টেড গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মা মারা গিয়েছিলেন অল্প বয়সে। তার বাবা থমাস মার্টেন বিয়ে করেন তারই সমবয়সি অ্যানকে।
সুন্দরী মারিয়া বিয়ের আগেই দুই সন্তানের মা হয়েছিলেন। মারিয়া ও থমাস কর্ডরের একটি সন্তান জন্মের পরেই মারা যায়। মারিয়ার আরেক প্রেমিক পিটার ম্যাথিউসের ছেলে থমাস হেনরি জীবিত ছিলেন। পিটার মারিয়াকে বিয়ে না করলেও নিয়মিত সন্তানের জন্য অর্থ প্রেরণ করতেন।
এমতবস্থায় সুন্দরী মারিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় থমাস কর্ডরের ছোট ভাই উইলিয়াম কর্ডরের। চুরি, জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ থাকলেও পরিচিত মহলে লেডি কিলার নামেই পরিচিত ছিলেন কর্ডন। পরে উইলিয়ামের মাধ্যমেও অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন মারিয়া।
এমতবস্থায় উইলিয়াম মারিয়াকে বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু সামাজিক বাধা থাকায় পালিয়ে বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেন তারা। রেড বার্ন নামে স্থানীয় একটি শস্যাগারের সামনে দেখা করার কথা ছিল তাদের। কথা ছিল, ইপসউইচে গিয়ে বিয়ে করবেন। কিন্তু এরপর মারিয়াকে আর দেখা যায়নি।
এই ঘটনার পর উইলিয়াম নিয়মিত মারিয়ার পরিবারকে চিঠি দিয়ে জানাতেন, তারা আইল অব উইটে বসবাস করছেন এবং ভালো আছে। কিন্তু মারিয়া কখনোই চিঠি না লেখায় সন্দেহ বাড়তে থাকে। উইলিয়াম মারিয়ার পরিবারকে বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে বলতেন, মারিয়ার হাত কেটে গিয়েছে, সে অসুস্থ রয়েছে, চিঠিটি হারিয়ে গেছে অথবা মারিয়ার আগের সন্তানদের মুখোমুখি হতে হবে, তাই লিখছেন না।
সেই সময়ই মারিয়ার সৎমা অ্যান এক রাত্রে স্বপ্ন দেখেন, মারিয়াকে শস্যাগারের পাশে খুন করা হচ্ছে। প্রথমে অ্যানের স্বামী আমলে না নিলেও দ্বিতীয় বার স্বপ্ন দেখার পর রাজি হন তিনি। অবশেষে ১৯২৪ সালের ১৯ এপ্রিল স্বপ্নের সূত্রে মাটি খোঁড়া শুরু হয়। বেরিয়ে আসে একটি কঙ্কাল। পোশাক, দাঁত, কঙ্কালের গড়ন ও গলায় একটি সবুজ রুমাল জড়ানো দেখে চেনা যায়, কঙ্কালটি মারিয়ার। সবুজ রুমালটি ছিল উইলিয়ামের।
শুরু হয় মামলা। প্রায় ১০০ বছর আগের এই মামলাটি ছিল সংবাদপত্র ও আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু। এই খুন নিয়ে লেখা হয় গান, কবিতা, উপন্যাস। তৈরি হয় সিনেমা। কিন্তু মারিয়ার খুনি কে? কর্ডর কি খুন করেছে মারিয়াকে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে রোজ আদালতে ভিড় করতেন হাজার হাজার মানুষ।
ফরেন্সিক সায়েন্স সেই সময় উন্নত না থাকায় সঠিক ভাবে মারিয়ার খুনের কারণ সম্পর্কে জানা যায়নি। তবে পুলিশ জানায়, মারিয়াকে প্রথমে গুলি করা হয়, তারপর শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, ধারালো অস্ত্রের আঘাতও ছিল তার গায়ে।
বারবার জেরা করার পর উইলিয়াম বলেছিলেন, মারিয়া আত্মহত্যা করায় সেই ‘পাপ‘ ঢাকতে তিনি সমাধিস্থ করেছিলেন। এরপরও উইলিয়ামের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৮২৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসির ঠিক আগ মুহূর্তে উইলিয়াম স্বীকার করেন, তিনি অপরাধী, এই শাস্তি তার ভাগ্যে লেখা ছিল।
উইলিয়ামের ফাঁসির পর তার জামাকাপড় ও ফাঁসির দড়ি চড়া মূল্যে বিক্রি হয়। উইলিয়ামের চামড়া ছাড়িয়ে সেই চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা হয় একটা বই। সেই বই আদালত চত্বরেই বিক্রি শুরু হয়েছিল চড়া দামে। সেই বইয়ে লেখা ছিল, তার কুকীর্তির কথা। বইটি বর্তমানে 'ময়েস হল মিউজিয়ামে' সংরক্ষিত আছে।
স্থানীয়দের কেউ কেউ বলেন, ওই এলাকায় মারিয়া মার্টেনের আত্মাকে নাকি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। অনেকেই বলেন, পুরোটাই মিথ। একেবারে অবৈজ্ঞানিক। তবে ২০০ বছর পেরিয়ে গেলেও ইংল্যান্ডের ওই এলাকায় ঘটনাটি নিয়ে চর্চা রয়েই গিয়েছে।
একটা তত্ত্ব অনুযায়ী, অ্যানের সঙ্গে মারিয়ার বয়সের তফাত ছিল সামান্যই। মারিয়ার পরে তার মা অ্যানের সঙ্গেও উইলিয়ামের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। উইলিয়াম ও অ্যান মিলে মারিয়াকে খুনের পরিকল্পনা করেন।
কিন্তু খুনের পর উইলিয়াম অ্যানকে সঙ্গে না নিয়েই পালিয়ে যান এবং অন্য একজনকে বিয়ে করেন। এই বিয়ের খবর পেয়েই অ্যান প্রতিশোধ নেবেন বলেই মিথ্যা স্বপ্নের কথা বলা শুরু করেন স্বামীকে। যদিও আদালতে নাকি উইলিয়াম কখনোই অ্যানের নাম উচ্চারণ করেননি। তাই এই হত্যা রহস্য নিয়ে এখনও পর্যন্ত ধোঁয়াশাই রয়ে গিয়েছে।
ইন্টারনেট অবলম্বনে লিখেছেন আশরাফ সিদ্দিকী