মানুষ দেখলে দৌড়ে পালানোর ভয় নেই। ঝোঁপঝাঁড় কিংবা গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখার কৌশলও খুঁজতে হচ্ছে না। প্রায় ১২ হাজার বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত গাজীপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে এখন স্বস্তির নিশ্বাস নিচ্ছে হাজারো প্রাণী।
আয়েশি ভঙ্গিতে জেব্রা, ওয়াইল্ড বিস্ট কিংবা হরিণ দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে গভীর বনের ভেতর। দলভুক্ত ছাড়াও ঘুরছে বাঘ সিংহ আর ভাল্লুক। হঠাৎ কোনো শব্দ পেয়ে জলে থাকা কুমির কিংবা কচ্ছপও চমকে উঠছে না।
গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে থাকা শত প্রজাতির হাজারো দুর্লভ প্রাণী যেন এখন বেশ স্বস্তিতেই আছে। জনমানবশূন্য সাফারি পার্কের নির্ধারিত বেষ্টনির ভেতর তারা খেলা করছে, দৌড়াদৌড়ি করছে মনের আনন্দে। চিরচেনা সাফারি পার্কের দৃশ্য ভিন্ন রকম। দর্শনার্থী নেই, প্রধান ফটকের সামনে দীর্ঘ লাইন নেই। করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবের শুরুর দিকেই পার্ক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারী ছাড়া বিশাল এই সাফারি পার্কে আর কেউ নেই।
সুনসান নীরব পার্কের ভেতর থেকে মাঝে মধ্যে ভেসে আসছে পাখির কলকাকলি, কখনো আবার বাঘ কিংবা সিংহের গর্জন। পার্কে থাকা অনেক প্রাণীর ঘরে এসেছে নতুন অতিথি। বন্ধকালীন সময়ে শুধু জেব্রার পালেই যুক্ত হয়েছে ৫টি শাবক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কোর সাফারির ভেতর ওয়াইল্ড বিস্ট, জেব্রা ও হরিণের দল লাফালাফি করছে। তাদেরকে বিরক্ত করারও কেউ নেই। সময় মতো তত্ত্বাবধায়ক তাদেরকে খাবার দিচ্ছেন। নির্ধারিত বেষ্টনীর ভেতর হাঁটাহাটি করছে তিনটি বাঘ ও চারটি সিংহ। তবে ভাল্লুকগুলো বন্দি করে রাখা হয়েছে।
পার্কের দায়িত্বে থাকা সহকারী বনসংরক্ষক তবিবুর রহমান বলেন, করোনা শুরুর পরপরই প্রথম বারের মতো প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি ভাল্লুক বাচ্চা প্রসব করেছে। দু’টি বাচ্চা দিলেও একটি খেয়ে ফেলেছে অন্য ভাল্লুক। একটি বাচ্চা নিয়ে আশ্রম থেকে বেশ দূরে ছায়াযুক্ত জায়গায় মা ভাল্লুক অবস্থান করছে। মাঝে মধ্যে খুনসুঁটিতে মেতে উঠছে তারা। এছাড়াও বেশ কিছু দুলর্ভ প্রাণি বাচ্চা দিয়েছে কয়েক মাসে। আবদ্ধ পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে আফ্রিকা থেকে আনা ব্ল্যাক সোয়ান ও মিউত সোয়ান। ডাঙ্গায় উঠে এসেছে কুমির।
তিনি আরও বলেন, পার্কে বাঘ আছে ১০টি, সিংহ ১৪, ভাল্লুক ১৪, জেব্রা ২২, ওয়াইল্ড বিস্ট ১৫টি। এছাড়া শত রকমের অন্তত ১ হাজার প্রাণি আছে। তাছাড়া জলের প্রাণি ও পাখি তো আছেই।
এরই মধ্যে পার্কে থাকা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্তপ্রায় একমাত্র স্ত্রী নীলগাইটি খুঁজে পেয়েছে পুরুষ সঙ্গী। গত ১৯ আগস্ট দিনাজপুরের রামসাগর জাতীয় উদ্যানের মিনি চিড়িয়াখানা থেকে পুরুষ নীলগাইটি গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে আনা হয়। গত বছরের ১ মার্চ এ নীলগাইটি নওগাঁর সাপাহার থেকে উদ্ধারের পর রাজশাহী বন্যপ্রাণী বনবিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে এটা রামসাগর জাতীয় উদ্যানে রাখা হয়। গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে থাকা দেশের একমাত্র স্ত্রী নীলগাইটির সঙ্গী করার জন্য রামসাগর জাতীয় উদ্যান থেকে সেটা আনা হয়।
তবে করোনার প্রভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাফারি পার্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকশ’ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। পার্কের ভেতর ও বাইরের রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে ইজারাদারদের লোকসান হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
পার্কের দায়িত্বে থাকা সহকারী বনসংরক্ষক তবিবুর রহমান বলেন, পার্কে দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ থাকায় প্রাণীকুল বেশ স্বস্তিতেই আছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। বাড়তি সেবাও দেয়া হচ্ছে তাদেরকে।
এদিকে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বনাঞ্চলে গড়ে তোলা কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কেও করোনা ভাইরাসের কারণে দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। এতে বিরাট সফলতা এসেছে বিভিন্ন পশু-পাখি ও বন্যপ্রাণীর প্রজননের ক্ষেত্রে। বিরল প্রজাতির প্রাণীর ঘরেও এসেছে নতুন অতিথি।
পার্কের দায়িত্বলীলরা বলছেন, সাফারি পার্ক বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত যদি বছরের ৬ মাস একনাগাড়ে বন্ধ রাখা যায়, তাহলে এসব প্রাণী প্রজননের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। যার সুফল ইতোমধ্যে এসেছে এই পার্কে। সেই হিসেবে আরো একমাস যদি এই পার্কে পর্যটক-দর্শনার্থী প্রবেশ না করে তাহলে প্রজননের ক্ষেত্রে ষোলকলা পূর্ণ হবে পার্কটির।
সরেজমিন দেখা গেছে, প্রায় পাঁচমাস ধরে পর্যটক-দর্শনার্থীর প্রবেশ না থাকায় পার্কের অভ্যন্তরে বিরাজ করছে সুনশান নিরবতা। উম্মুক্ত থাকাকালীন পার্কের ভেতর যেভাবে ময়লা-আবর্জনার দেখা মিলতো বর্তমানে সেসবের দেখা নেই। শুধুমাত্র হরেক রকমের পশু-পাখি ও বন্যপ্রাণীর কোলাহলে মুখর হয়ে রয়েছে পার্কটি। মানুষের বিচরণ না থাকায় নতুন করে গজিয়ে উঠেছে বিভিন্ন রকমের গাছ-গাছালি ও লতাগুল্ম। এসব কারণে পশু-পাখি ও বন্যপ্রাণীর জন্য বর্তমানে নিরাপদ আবাসস্থলে পরিণত হয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কটি।
টাইমস/এসই/এসএন