রোনাল্ড রিগ্যান: অভিনেতা থেকে প্রেসিডেন্ট

রোনাল্ড রিগ্যান। আমেরিকার একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনেতা। মূলত তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় একজন অভিনেতা। একসময় জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। তারপর ৪০তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পা রাখেন হোয়াইট হাউসে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে মার্কিন অর্থনীতির বিকাশ ও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

রিগ্যান ১৯১১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ইলিনয় অঙ্গরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন সেলসম্যান। তাই পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন শহরে তিনি বড় হয়েছেন। তবে পড়ালেখা করেছেন ইলিনয়ের ইউরেকা কলেজে। কলেজে থাকার সময় তিনি ছিলেন ছাত্র সংসদের সভাপতি। এরই সুবাদে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন।

ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে তিনি একটি রেডিওতে ঘোষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে ১৯৩৭ সালে ওয়ার্নার ব্রাদার্স ফিল্মে অভিনয়ের সুযোগ পান। এরপর থেকে বেশ কয়েক বছর তিনি বিভিন্ন ফিল্মে অভিনয় করেন। সব মিলিয়ে তিনি হলিউডে প্রায় ৫০টি ফিল্মে কাজ করেছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তার অভিনয় ক্যারিয়ারে বাঁধা পড়ে। ১৯৪২ সালে সরকারের নির্দেশে তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীতে চলে যান। সেখানে চার বছর তিনি সরকারের পক্ষে যুদ্ধের জন্য প্রমোশনাল ফিল্মে কাজ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনি ১৯৪৭-১৯৫২ সময় পর্যন্ত স্ক্রিন অ্যাক্টর্স গিল্ডের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি একটি টিভি সিরিজের সঞ্চালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই অনুষ্ঠানের প্রচারণার কাজে তিনি আমেরিকার বিভিন্ন শহর ভ্রমণ করেন। এসময় রিপাবলিকান দলের সঙ্গে রাজনীতিতে জড়িয় পড়েন তিনি। ১৯৬৫-৬৭ মেয়াদে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৮ ও ১৯৭৬ সালে দুইবার তিনি রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে ব্যর্থ হন। অবশেষে ১৯৮০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান। এ নির্বাচনে তিনি হেভিওয়েট ডেমোক্রেট প্রার্থী জিমি কার্টারকে ৪৮৯-৪৯ ইলেক্টোরাল ভোটে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ৬৯ বয়সী রোনাল্ড রিগ্যান ছিলেন আমেরিকার সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট। পরে ১৯৮৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৮১ সালের ২০ জানুয়ারি উদ্বোধনী ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন আমেরিকার সমস্যাগুলোর সমাধান সরকারের হাতে নেই। কারণ সরকার নিজেই সমস্যাগ্রস্ত। তাই তিনি জাতীয় সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন এবং মার্কিন সরকারকে জনগণের জন্য আশার প্রদীপ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন।

তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে রিগ্যানের যাত্রাটা মসৃণ হয়নি। ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ তাকে হত্যার জন্য গুলি চালায় কতিপয় দুষ্কৃতিকারী। যদিও অল্পের জন্য সে যাত্রা তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন।

তিনি এমন এক সময় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন যখন মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, গ্যাসের মূল্যের ক্রমবৃদ্ধিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত মার্কিন অর্থনীতি। তখন মার্কিন অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে তিনি বেশ কিছু রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করেন।

তিনি চেয়েছিলেন জনগণ সরকারের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেদের চেষ্টায় নিজ নিজ সমস্যার সমাধান করুক। তাই তিনি জাতীয় সংস্কারের অংশ হিসেবে কর কর্তন করেছিলেন এবং বিভিন্ন সরকারী কর্মকাণ্ডের লাগাম টেনে ধরেছিলেন। পাশাপাশি সামরিক খাতকে শক্তিশালী করতে তিনি ব্যয় বাড়িয়ে ছিলেন।

প্রেসিডেন্ট পদে আসার পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১৩.৫ শতাংশ। যেখানে আট বছর পর তার অবসরকালে মুদ্রাস্ফীতি ৪ শতাংশে নেমে আসে। একই সঙ্গে তার মেয়াদের শেষ দিকে আমেরিকার বেকারত্বের হারও অনেকটা কমে আসে।

প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে মার্কিন সামরিক শক্তিকে বেশি শক্তিশালী করার ঘোষণা দেন, যা স্নায়ুযুদ্ধকে আরও তীব্র করে তুলেছিল। তবে ১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্ভাচেভ সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতায় আসলে তিনি স্নায়ুযুদ্ধ শিথিল করার সুযোগ পান। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই দুই নেতা একমত হন।

১৯৮৭ সালে এক ভাষণে তিনি বার্লিন দেয়াল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য মিখাইল গর্ভাচেভের প্রতি আহবান জানান। ফলস্বরূপ ১৯৮৯ সালে মিখাইল গর্ভাচেভের নির্দেশে বার্লিন দেয়ালের পতন হয়। এতে দুই জার্মানি একত্রিত হয় এবং দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে চলা স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে।

বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত রাষ্ট্রগুলোকে সাহায্য দিতে তিনি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, যা ‘রিগ্যান ডক্ট্রিন’ নামে পরিচিত। এছাড়া লেবাননে ও গ্র্যানাডায় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফির সঙ্গে চুক্তি করেছিল রিগ্যানের প্রশাসন।

১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি অবসরে যান। ১৯৯৪ সালে তিনি আলজেইমার্স রোগে আক্রান্ত হন। প্রায় এক দশক পর ২০০৪ সালে ৫ জুন না ফেরার দেশে চলে যান এই মহান ।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
হাইতিতে হারিকেন মেলিসার তাণ্ডব, প্রানহানি কমপক্ষে ২০ Oct 30, 2025
img
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বড় সুখবর, বরাদ্দ দেয়া হলো ১৩২ কোটি টাকা Oct 30, 2025
img
বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলো দক্ষিণ আফ্রিকার নারী দল Oct 30, 2025
img
নাগরিকদের তথ্য চেয়ে এসএমপির গণবিজ্ঞপ্তি জারি Oct 30, 2025
img
রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিক্ষার পথ প্রসারিত করলো কসোভো Oct 30, 2025
img
প্রেক্ষাপট উপস্থাপনায় জাকিয়া বারী মম Oct 30, 2025
img
জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ পোস্টে ফেসবুক সরগরম, কিন্তু কেন? Oct 30, 2025
img
ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ করে আনন্দিত শি জিনপিং Oct 30, 2025
img
৩১ সংস্থা প্রধানদের সঙ্গে ইসির বৈঠক আজ বিকেলে Oct 30, 2025
img
আমাদের দেশ থেকে যৌতুক প্রথা নির্মূল করার সময় এসেছে : রাজকুমার রাও Oct 30, 2025
img
তৃতীয় টি-টোয়েন্টির জন্য দল ঘোষণা করল বিসিবি Oct 30, 2025
img
পাকিস্তানের আকাশে বিরল মেঘের দৃশ্য Oct 30, 2025
img
বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করতে চায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ Oct 30, 2025
img
ভারত-পাকিস্তানকে ২৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কড়া বার্তা দিয়েছিলাম : ট্রাম্প Oct 30, 2025
img
ঢাকায় বজ্রসহ বৃষ্টি আভাস Oct 30, 2025
img
দেশের ৮ বিভাগে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বজ্রসহ বৃষ্টির আভাস Oct 30, 2025
img

গাজায় প্রাণহানি চলছে

দুপুরে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ঘোষণা দিয়ে সন্ধ্যায় আবার ইসরায়েলের হামলা Oct 30, 2025
img
ঘরের সব কাজ করবে রোবট ‘নিও’ Oct 30, 2025
img
দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে ট্রাম্প-শি বৈঠক আজ Oct 30, 2025
img
লিবিয়ার উপকূলে নৌকাডুবি, বেঁচে ফিরেছেন ১৮ বাংলাদেশি Oct 30, 2025