যে আন্দোলনটি আড়ালে রাখতে চায় পাকিস্তান

পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী একটি রাষ্ট্র। প্রতিনিয়ত এখানে অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। কিন্তু এর অনেকগুলো আন্দোলনের খবর বিশ্বকে জানতে দেয়া হয় না।

নীরবে নিভৃতে প্রতিদিন সেখানে অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। সংবাদ মাধ্যম আর সরকারি কর্তৃপক্ষের অনীহার কারণে বিশ্বের কেউই এসব গল্প সম্পর্কে জানতে পারেন না।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনার প্রতিবাদে প্রায় সময়ই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন পাকিস্তানের জনগণ। যা বরাবরের মতই বিশ্ববাসীর চোখ থেকে আড়ালে থেকে যায়। এর সর্বশেষ নজির দেখা যায় সম্প্রতি ইসলামাবাদের ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবের বাইরে।

ক্লাব এলাকার বাইরের উন্মুক্ত একটি স্থান, যাকে অনেকেই পাকিস্তান হাইড পার্ক বলে থাকেন। কারণ এই স্থানটি মূলত বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহার হয়। যা অনেকটা আমাদের দেশের শাহবাগ কিংবা প্রেস ক্লাব চত্বরের মত।

সেদিন একটি নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীর ধর্মীয় সেমিনার শেষে শত শত শিক্ষার্থী পাকিস্তান হাইড পার্কে জড়ো হয়। তারা মূলত কাশ্মীর দিবস উদযাপনের লক্ষ্যে একটি কর্মসূচির অংশ হিসেবে সেখানে সমবেত হয়েছিলেন।

কাশ্মীর দিবস পাকিস্তানে একটি সরকারি ছুটির দিন। এ দিনটি উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীরে ভারতের সামরিক বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা।

লক্ষণীয় বিষয় হলো- এই কাশ্মীর দিবসের র‍্যালি থেকে কিছু তরুণকে বাছাই করে গ্রেফতার করতে ব্যস্ত ছিল পাকিস্তানের পুলিশ। পুলিশের ধারণা, এই তরুণরা একই ভেন্যুতে আয়োজিত অন্য একটি র‍্যালিতে অংশ নিতে এসেছিলেন।

কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য না হলেও এরা ছিল একটি অধিকার আন্দোলনের সমর্থক। যারা মূলত পাকিস্তানের আফগান সীমান্তে সংখ্যালঘু পশতুন উপজাতিদের ওপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে সমবেত হয়েছিলেন।

সেদিন সেখান থেকে পশতুন তাহাফফুজ মুভমেন্টের (পিটিএম) ত্রিশজন সমর্থককে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। অথচ পাশেই একইধরনের কর্মসূচি কাশ্মীর র‍্যালি অত্যন্ত নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বক্তারা কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন, আর মিডিয়াগুলো সেই সংবাদ প্রচার করছিল।

নাটকীয়ভাবে দেখা যায়, যখন পুলিশ অন্য একটি র‍্যালি থেকে পিটিএম সদস্যদের গ্রেফতার করছিল, তখন বেশ কিছু মিডিয়াকর্মী ক্যামেরা নিয়ে সেদিকে ছুটে গিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল যে- তারা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে পিটিএম সদস্যদের গ্রেফতারের ঘটনাটি প্রচার করবেন। কিন্তু না, কে কার আগে ঘটনাটি প্রচার করবে সে উদ্দেশ্যে নয়। বরং এটা ছিল তাদের কেবল সাংবাদিকসূলভ আচরণ।

কারণ, সে দিন ইসলামাবাদসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন স্থানে কাশ্মীর দিবস পালনের ঘটনাগুলো পাকিস্তানের বিভিন্ন মিডিয়ায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়। অথচ পিটিএম সদস্যদের গ্রেফতারের একটি ভিডিও পর্যন্ত সে দিন কোনো মিডিয়ায় প্রচারিত হয়নি। এমন কি পরের দিন কোনো সংবাদপত্রের শিরোনামেও নয়। কিন্তু কেন?

এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, আফগান সীমান্তে উপজাতি-অধ্যুষিত পাকিস্তানের ছয়টি উপকূলীয় জেলা রয়েছে। এ গুলোকে একত্রে ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়াস (ফাতা) বলা হয়।

৯/১১ এরপর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করলে হাজার হাজার তালেবানযোদ্ধা এসব অঞ্চলে ঘাঁটি স্থাপন করে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এই তালেবান যোদ্ধাদের সমর্থন করে। কারণ, পাকিস্তান কখনো চায় না যে, ভারতের একটি শক্তিশালী মিত্র হিসেবে আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠিত হোক। তাই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সমর্থন ও সহযোগিতায় তালেবানযোদ্ধারা এসব অঞ্চলে আশ্রয় লাভ করেছেন।

ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে সেখানকার লাখ লাখ স্থানীয় বাসিন্দা আজ ভয়ানকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। প্রতিদিন সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। তাদের নির্যাতনে ইতোমধ্যে প্রায় তিন মিলিয়নেরও বেশি লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর চাপে কখনও পশতুনদের নির্যাতিত হবার সেই গল্পগুলো গণমাধ্যমে আসে না। যদিও সর্বশেষ পিটিএম সদস্যরা এই নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে জনসম্মুখে নিয়ে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করছেন।

তারা তালেবানযোদ্ধা ও পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর দ্বারা এসব উপকূলীয় এলাকায় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নিয়ে বিভিন্ন ডকুমেন্টারি প্রচার করছেন। তবে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বাঁধা ডিঙ্গিয়ে তাদের সে প্রচেষ্টা কতদূর এগিয়ে যাবে, তা সময়ই বলে দেবে।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on: