‘ছাত্র রাজনীতির প্রথম ও শেষ কথা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের কল্যাণ নিশ্চিত করা’

অনেক জল্পনা-কল্পনার পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন। চলতি বছরের ১১ মার্চ ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে দীর্ঘদিনপর ডাকসু নির্বাচন হওয়াতে দেশের রাজনীতিক দলগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। এছাড়াও ওই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে পুরো দেশবাসি। সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ টাইমসের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক এস এম মারুফ। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন বাংলাদেশ টাইমসের নিউজ রুম এডিটর হেলাল উদ্দিন।

বাংলাদেশ টাইমস: কেমন আছেন?

মারুফ: ভালো আছি। আপনি নিশ্চয়ই ভালো আছেন।

বাংলাদেশ টাইমস: আমিও ভালো আছি। দীর্ঘদিন পর ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে সেটাকে কিভাবে দেখছেন?

মারুফ: দীর্ঘ ২৮ বছর পর আগামী ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, এটা অবশ্যই ভালো খবর। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৬ জুন। তারপর একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও ডাকসু নির্বাচন আলোর মুখ দেখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন স্ব-দলীয় রাজনৈতিক চর্চা করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মী ও অনুসারির সংখ্যার চেয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা অনেক বেশি। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দলীয় সিদ্ধান্তে ঠিক করা হয়, সেখানে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। এজন্য বর্তমান ছাত্র সংগঠনগুলোর দ্বারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ অনেকাংশেই সংরক্ষিত হয় না । কিন্তু ডাকসু নিবার্চনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী (বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত নীতিমালা অনুযায়ী যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য) ভোটের মাধ্যমে তাদের নেতা নির্বাচন করবে। ফলে নির্বাচিত নেতৃত্ব ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে বাধ্য হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যারা নির্বাচিত হবে তারা দলীয় রাজনৈতিক পরিমন্ডলের বাইরে কতটুকু আসতে পারবে এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহকে কতটুকু অগ্রাধিকার দিবে।

বাংলাদেশ টাইমস: নির্বাচনের পরিবেশ কতটুকু আছে বলে মনে করেন?

মারুফ: কোনো নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু আছে কিনা তা বোঝার জন্য প্রথমেই যে বিষয়টি দেখতে হবে তা হচ্ছে, নির্বাচন করার যোগ্য সব দল বা সংগঠন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে কিনা। এদিক থেকে ডাকসু নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজমান আছে। কারণ এখন পর্যন্ত সকল ছাত্র সংগঠন নির্বাচনমুখী এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচন আয়োজনে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। নির্বাচনের তফসিলও ঘোষণা করা হয়েছে। সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সমান সুযোগ দিতে হবে। এ বিষয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সবার জন্য একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশ নিশ্চিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।

বাংলাদেশ টাইমস: ‘ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের সহাবস্থানে আপত্তি নেই ছাত্রলীগের’, ছাত্রলীগ নেতাদের এই বক্তব্যের বিষয়ে আপনার অভিমত কি?

মারুফ: ছাত্রলীগ নেতাদের এই বক্তব্য অবশ্যই ইতিবাচক এবং প্রশংসনীয়। একই সাথে কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল নেতাদের পাশাপাশি দাড়িঁয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা এবং ছাত্রদল নেতাদের মিছিল করার দৃশ্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই বক্তব্যের কার্যকর প্রয়োগের জন্য ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল উভয়পক্ষকেই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশ টাইমস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য নিয়মিত নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছেন। এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন? তা কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করেন?

মারুফ: বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলে নিয়মিত নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। তবে নিয়মিত নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর, বিশেষ করে বড় দুটি দলের ছাত্র সংগঠনের সার্বিক সহযোগিতা অবশ্যই থাকতে হবে। কারণ অতীতে একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বড় ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্যে না আসায় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হয়নি। নির্বাচন ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে ক্যাম্পাসের ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো যখন একই সরল রেখায় অবস্থান করবে তখন নিয়মিত নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।

বাংলাদেশ টাইমস: নেতৃত্ব তৈরিতে এই নির্বাচনের কি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন?

মারুফ: নেতৃত্ব ধীরে ধীরে গড়ে উঠে। নেতৃত্ব তৈরি করা সময় সাপেক্ষ বিষয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও নির্বাচন নেতৃত্ব তৈরির গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ডাকসু নির্বাচনে যারা নেতা নির্বাচিত হবেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর নেতা হবেন।, নির্দিষ্ট কোন গ্রুপ বা অংশের নয়। নির্বাচিত নেতাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের পরিধি হবে অনেক বড়। ছাত্র অবস্থায় একজন শিক্ষার্থী যখন তার ৩০-৩৫ হাজার সহপাঠির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হবে এবং সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারবে তখন তার মধ্যে নেতৃত্বের গুনাবলী বিকশিত হবে। পরিচ্ছন্ন ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ তৈরির জন্য ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশ টাইমস: জাতীয় রাজনীতিতে এ নির্বাচনের ভূমিকা কি হবে?

মারুফ: ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্র সমাজের কথা বলে। এদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্র সমাজ বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান-বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অনেক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্র সমাজ। সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য ডাকসু নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক বার্তা দিবে।

বাংলাদেশ টাইমস: নির্বাচনকে ঘিরে কোনো সহিংস পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা আছে কি?

মারুফ: এখন পর্যন্ত আমি এরকম কোনো আশঙ্কা দেখছি না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শক্ত অবস্থানে থাকলে যে কোনো ধরণের সংহিসতা এড়িয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।

বাংলাদেশ টাইমস: নির্বাচনে সকল দল সমান সুযোগ পাবে বলে মনে করেন?

মারুফ: দেখুন, আপনি যখন একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলবেন তখন অবশ্যই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। আর এ দায়িত্ব নির্বাচন আয়োজকদের। ডাকসু নির্বাচনে সকল দল সমান সুযোগ পাবে কিনা তা নির্ভর করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভুমিকার উপর।

বাংলাদেশ টাইমস: নির্বাচনে কি কি বাঁধা বা চ্যালেঞ্জ আছে বলে আপনি মনে করেন?

মারুফ: বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এবং আবাসিক হলগুলোতে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা প্রথম চ্যালেঞ্জ। তফসিল ঘোষণার পর ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচনী আচরণ-বিধিমালা মেনে চলছে কিনা সেটি নিশ্চিত করাও একটি বাঁধা হতে পারে। মোট ভোটারের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার আবাসিক হলের বাইরে অবস্থান করে। নির্বাচনের দিন তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

বাংলাদেশ টাইমস: এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় আপনার পরামর্শ কি?

মারুফ: শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোকে দার্য়িত্বশীল ও সহনশীল আচরণ করতে হবে। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভুমিকা পালন করতে হবে। ভোট কেন্দ্র যেহেতু হলের ভেতরে তাই হলের বাইরের ছাত্র-ছাত্রীরা যেন নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সেদিকে হল প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

বাংলাদেশ টাইমস: একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতি আপনার উপদেশ কি?

মারুফ: ছাত্র রাজনীতির প্রথম এবং শেষ কথা হচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণ নিশ্চিত করা। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের যে কোনো সমস্যায় ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের যেন পাশে পায় এ বিষয়টি ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে। মানবিক নেতৃত্বের গুনাবলী অর্জনের জন্য ছাত্র নেতাদের সমাজ সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। ছাত্র সংগঠনগুলো কল্যাণ তহবিল গঠন করে আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতা প্রদান করতে পারে। নিজের ব্যক্তিত্ব অর্জন, নিজেকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলা এবং নিজেকে বিকশিত করার বড় মঞ্চ হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি। এটিকে ইতিবাচক অর্থে কাজে লাগাতে হবে।

বাংলাদেশ টাইমস: আপনার মূল্যবান সময় প্রদানের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।

মারুফ: আপনার জন্য শুভকামনা।

টাইমস/এইচইউ/ কেআরএস

Share this news on:

সর্বশেষ