যে কারণে চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখনও কোনো কারণ জানাতে পারেনি সরকারি দফতরগুলো। ঘটনার কারণ জানতে ও বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ লোকজন ও ঘটনাস্থলের আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের বেশ কয়েকটি কারণ জানা গেছে।

কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঘটনাস্থল ও আশপাশ এলাকায় কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের গোডাউন, গ্যাস সিলিন্ডার, সরু রাস্তা ও তীব্র যানজট। ওই সমস্যাগুলো না থাকলে এত বড় ঘটনা থেকে মুক্তি পাওয়া যেত বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়রা জানান, বুধবার রাত পৌনে ১১টার দিকে চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশে ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচতলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। ওই ভবনের নিচ তলায় একটি খাবারের হোটেল, কেমিক্যাল কারখানা, জুতার দোকান ও প্লাস্টিকের দোকানসহ বেশ কয়েকটি দোকান ও গোডাউন ছিল। তবে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে কেমিক্যালের গোডাউন ও খাবারের দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে ছড়িয়ে পড়ায় খাবারের দোকানের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুনের ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে আগুনের তাপে ওয়াহিদ ম্যানশনের পাশে একটি বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ হয়। এরপর পাশের ভবনগুলোতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

তবে আগুনের ভয়াবহ রূপ নেওয়ার পিছনে তীব্র যানজট ও সরু রাস্তাকে দায়ী করছেন অনেকেই। তাদের মতে, আগুন লাগার পূর্ব থেকে সেই এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির রাত হওয়াতে অন্য দিনের তুলনায় যানজটের পরিমাণটা বেশি ছিল। তাই সেই এলাকায় যানজটে আটকা পড়া অনেকেই হতাহতের শিকার হয়েছেন।

সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সেই এলাকার রাস্তাগুলো অনেক সরু। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেই রাস্তা দিয়ে সহজে বের হতে গেলেও হতাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যা বুধবারের রাতেই ঘটেছে।

 

স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ মনসুর মিয়া বাংলাদেশ টাইমস-কে জানান, পুরান ঢাকায় গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশিভাগ সময় গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকে। এছাড়াও ছোট রাস্তা, গলির ভেতরে কেমিক্যাল কারখানা গড়ে উঠায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এটার দ্রুত সমাধান না হলে এমন দুর্ঘটনা আরও হতে পারে মনে করেন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী তৈয়েবুর রহমান তপু নামের এক পুলিশ সদস্য সাংবাদিকদের জানান, বুধবার রাতে সোয়ারীঘাটে দায়িত্ব পালন শেষে মোটরসাইকেলযোগে চকবাজারের চুড়িহাট্টার গলি হয়ে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। সেই সময় ঘটনাস্থলের পাশেই যানজটে আটকা পড়েন তিনি। গলিটির ভেতরে মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যান, প্রাইভেটকার ও ঠেলাগাড়িতে আটকা ছিল। সেই সময় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। এ সময় একটি বিকট শব্দ হয়। এ শব্দ হওয়ার পর তিনিসহ আশপাশের মানুষগুলো ভয়ে ছুটাছুটি শুরু করে। এক পর্যায়ে তিনি মোটরসাইকেল রেখে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, চোখের সামনেই মাত্র ২০-২২ ফুট দূরে রাজ্জাক ভবনে হু হু করে আগুন জ্বলছে। আমি এতোটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি যে মসজিদের বাঁ-পাশের সরু গলি দিয়ে দৌড় দিই। কিছু দূর যাওয়ার পর পেছনে ফিরে দেখি, চুড়িহাট্টা গলির রাস্তার সব গাড়ি আর ভবন পুড়ছে। এ সময় তার মোটরসাইকেলটিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

তিনি বলেন, মোটরসাইকেল রেখে পালিয়ে না গেলে আমিও পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম।

ঢামেক মর্গে আসা রাজু নামের একজন জানান, চকজাবারের চুড়িহাট্টা যে ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেই ভবনের নিচ তলায় তিনি জুতার ব্যবসা করতেন। তবে তিনি নিজে বেঁচে গেলেও তার আশপাশের দোকানীরা হতাহত হয়েছেন। সেই এলাকায় কেমিক্যাল কারখানা ও রাস্তা সরু হওয়ায় এত বড় দুঘর্টনা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণ জানতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি শিল্প মন্ত্রণালয় এবং অন্যটি ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মফিজুল হককে প্রধান করে গঠিত ১২ সদস্যের কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়াও ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন্স) দিলিপ কুমার ঘোষকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের কমিটি ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া কথা রয়েছে।

তবে পুরান ঢাকায় আর দাহ্য পদার্থের গোডাউন রাখতে দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সোমবার থেকে রাসায়নিক কারখানার বিরুদ্ধে তিনি অভিযান শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার দুদিনের মাথায় এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছে। চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে। কোনোভাবেই আর এখানে কেমিক্যাল গোডাউন রাখতে দেবো না। এজন্য কঠোর থেকে কঠোরতম পদক্ষেপ নেয়া হবে।

সাঈদ খোকন আরও বলেন, এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

টাইমস/ কেআরএস/এইচইউ

Share this news on: