কোকিলকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকরের জীবনকাহিনী

সঙ্গীত জগতের বিশাল একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো রোববার (৬ ফেব্রুয়ারি)। মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতের কিংবদন্তি গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। এরই মধ্য দিয়ে অবসান ঘটলো একাধিক যুগের। তবে অবশিষ্ট রইলো তার কণ্ঠে বাংলাসহ ৩৬টি ভাষায় গাওয়া ৭ হাজার ৫০০টি গান।

নিজের ৭০ বছরের বর্ণাঢ্য সঙ্গীতজীবনে এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। গান গেয়ে বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জনের পাশাপাশি পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা।

বহু পুরস্কার ও সম্মাননা আছে লতার অর্জনের ঝুলিতে। ২০০১ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্নে ভূষিত হন। এছাড়া ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণ এবং ১৯৬৯ সালে তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ অর্জন করেন তিনি। এছাড়া ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের অফিসার খেতাব প্রদান করে লতাকে।

এছাড়া দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (১৯৮৯), মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার (১৯৯৭), এনটিআর জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৯), জি সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (১৯৯৯) এএনআর জাতীয় পুরস্কার (২০০৯), শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ৩টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার ও ফিল্ম ফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ অসংখ্য অর্জন আছে লতার।

লতা মঙ্গেশকরের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর ভারতের মধ্য প্রদেশে। বাবা পন্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন শাস্ত্রীয়সংগীত শিল্পী। বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে পরিবারের হাল ধরতে হয় লতাকে। এ সময়ই গান গাওয়া শুরু করেন তিনি।

মাত্র ১৯ বছর বয়সে ‘মজবুর’ চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেয়ার মাধ্যমে প্লেব্যাকে হাতেখড়ি হয় লতা মঙ্গেশকরের। তবে ১৯৪৯ সালে প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পী মধুবালা অভিনীত ‘মহল’ ছবিতে তার গাওয়া ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। 

লতা মঙ্গেশকর শুধু সর্বকালের অন্যতম সেরা কণ্ঠশিল্পী নন, তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র ও সংগীতশিল্পের অন্যতম সেলিব্রিটিও ছিলেন। পেশাগত জীবনে অগণিত পুরস্কার, ট্রফি, প্রশংসায় ভেসেছেন। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন অবাক করার মতো ছিল। কারণ, তিনি সারা জীবন অবিবাহিত ছিলেন।

যদিও তিনি নিজে কখনো এ বিষয়ে মুখে তেমন কিছু বলেননি, কিন্তু বলিউড শাদিজ ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে এই নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে লতা মঙ্গেশকরের জীবনের শেষ পর্যন্ত বিয়ে না করার সিদ্ধান্তের পেছনে দুটি প্রধান কারণের কথা বলা হয়েছে।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়, কিংবদন্তি গায়িকা লতা মঙ্গেশকরের বিয়ে না করার সিদ্ধান্তের পেছনে দুটি প্রধান কারণ আছে। প্রথমটি একটি সুপরিচিত সত্য যে ছোটবেলা থেকেই তিনি তার ভাই-বোন, মীনা, আশা, ঊষা এবং হৃদয়নাথের প্রতি খুবই স্নেহপ্রবণ ছিলেন। তাদের শিক্ষা থেকে শুরু করে নিজ নিজ ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করতে লতা প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন। এভাবেই তার জীবনের বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়েছে, দশকের কর দশক কেটে গেছে। কিন্তু, তিনি বিয়ে করেননি। তিনি যখন বিবাহকে আলিঙ্গন করার কথা ভাবলেন তখন ভাগ্য দেবী তার সহায় হলেন না।

সেই প্রতিবেদন আরো বলা হয়, লতার ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্রয়াত ক্রিকেটার এবং ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (বিসিসিআই) প্রাক্তন সভাপতি রাজ সিং দুঙ্গারপুর। প্রাক্তন এই ক্রিকেটার রাজস্থানের রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন এবং দুঙ্গারপুরের তৎকালীন শাসক প্রয়াত মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংজির কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন।

হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর এবং রাজ সিং দুঙ্গারপুর সত্যিই ভালো বন্ধু ছিলেন। তাদের বেশিরভাগ আড্ডা হতো হৃদয়নাথের বাড়িতে। সেখানেই রাজ সিং বন্ধুর বড় বোন লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। রাজ সিং এবং লতার কয়েকবার দেখা করার পর একে অপরের প্রেমে পড়েন। আরও জানা যায়, রাজ সিং লতা মঙ্গেশকরকে 'মিঠু' নামে ডাকতেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, লতা মঙ্গেশকর এবং রাজ সিং দুঙ্গারপুর দুজনেই বিয়ে করার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু, তিনি যখন তার বাবা-মাকে এই বিষয়ে জানান তখন তার বাবা, মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংজি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর পিছনে কারণ ছিল লতা কোনো রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন না। তাই মহারাওয়াল লক্ষ্মণ তার ছেলে রাজ সিংকে একটি সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করতে দিতে পারেননি।

মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংজির দৃঢ় সিদ্ধান্ত রাজ সিং দুঙ্গারপুর এবং লতা মঙ্গেশকরের স্বপ্নের দুর্গটি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভেঙে দিয়েছিল। বাবার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার কারণে পিতার সিদ্ধান্ত মেনে নেন তিনি। কিন্তু, রাজসিং তার পুরো জীবনে কাউকে বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা করেন এবং সেই কথা বাবা-মাকেও এ কথা জানিয়েছিলেন। যাই হোক, লতা মঙ্গেশকরও একই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবং দু'জনেই আজীবন বন্ধু ছিলেন।

২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রাজ সিং দুঙ্গারপুর আলঝাইমার রোগের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মুম্বাইয়ে মারা যান। হয়তো তাদের প্রেমের গল্পটির সর্বোত্তম সমাপ্তি ছিল না। তবে, শেষ পর্যন্ত দু'জন যেভাবে প্রতিজ্ঞা মেনে চলেছেন তা আজকের সময়ে অবশ্যই বিরল।
তবে, লতা মঙ্গেশকর এবং রাজ সিং দুঙ্গারপুর তাদের সম্ভাব্য সম্পর্কের খবরে কখনো কোনো কথা বলেননি বা প্রতিক্রিয়া জানাননি।

এত সব অর্জনের পরও লতা মঙ্গেশকর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি মনে করতে পারেন না কোনটি তার জীবনের সেরা গান, সেরা মুহূর্ত। গানটাই যেন তার জীবনের এক অন্য যাত্রাপথ।
তিনি বলেছিলেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে আরেকটু যত্নবান হওয়া দরকার ছিল, আরও কিছু কাজ করা বাকি ছিল তার। সেই বাকি কাজগুলো তার অসমাপ্তই রয়ে গেল।




Share this news on:

সর্বশেষ

img
শিডিউল বিপর্যয়ে ভোগান্তিতে যাত্রীরা, ৬ ট্রেনের যাত্রা বাতিল May 04, 2024
img
সরকার গণমাধ্যমের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতে কাজ করছে: প্রতিমন্ত্রী May 04, 2024
img
শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন বাড়াতে কাজ করছে সরকার : শিক্ষামন্ত্রী May 04, 2024
img
ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হামাস May 04, 2024
img
যাত্রা শুরু করলো কমিউনিকেশান এসোসিয়েশান অব বাংলাদেশ May 04, 2024
img
সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির সমাধানে যা করবেন May 04, 2024
img
মিয়ানমার থেকে ৪০ বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে May 04, 2024
img
পেঁয়াজ রপ্তানি থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলল ভারত May 04, 2024
img
নোয়াখালীতে ট্রাক-সিএনজি সংঘর্ষ, নিহত ৪ May 04, 2024
img
দুই ট্রেনের সংঘর্ষ : ২৪ ঘণ্টায়ও শেষ হয়নি উদ্ধারকাজ, ভয়াবহ শিডিউল বিপর্যয় May 04, 2024