‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ অতি পরিচিত এই লাইন দুটি কাজী নজরুল তো কবেই লিখে গেছেন; তবুও পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা আজ অবহেলিত, শোষিত। বর্তমান সমাজে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছে।
আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন : জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’। বাংলাদেশেও প্রতিবছর নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে আসছে এ দিনটি। বর্তমান সমাজে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। এ সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে নারীর অবদান রয়েছে। তবুও নারীরা আজ ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়, দিন দিন বেড়েই চলছে নারীর প্রতি সহিংসতা।
এদেশে এখনো নারীরা একা পথ চলতে ভয় পায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউই কুৎসিতরূপী ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা। উচ্চশিক্ষা অর্জনে ও নারীরা বাধার মুখে পড়ছে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের নারীরা। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা, ভালবাসা প্রকাশ করে এই দিনটিকে পালন করা হয়। নারী দিবস উপলক্ষে নারী শিক্ষার্থীর ভাবনা ও মতামত তুলে ধরেছে বাংলাদেশ টাইমস । শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন মোঃ শাহিন আলম।
বর্তমান সময়ে নারীরা সমতা নয় ক্ষমতা চায়। তবে এ ক্ষমতা পুরুষদের দাবিয়ে রাখতে না, একে অপরকে সহযোগিতার মাঝে সমাজের সকল বাঁধা বিকল্প কে প্রতিহত করার। নারীদের অবস্থান আজো সমাজে সঠিক ভাবে প্রকাশিত হতে পারেনি। এতে শুধু যে পুরুষ বাঁধা দেয় তা নয়। বাঁধা দেয় তার মন। তবে সব বাঁধা কে প্রতিহত করে নারীদের সর্বপ্রথম হতে হবে শিক্ষিত। একজন শিক্ষিত নারীর সঠিক মূল্য সেই নারীও জানে না। নেপোলিয়ন বলেছিলেন "আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো". শিক্ষা প্রাপ্তির জন্য সকল কষ্ট, বাঁধা বিকল্প পার করতে নারীকে হতে হবে মানসিক ভাবে শক্ত। আর সকল নারীর আর্থিক ভাবে সাবলম্বী হওয়া অতি প্রয়োজন। বাবা কিংবা স্বামীর টাকা দিয়ে নিজের সকল চাহিদা পূরণ সম্ভব তবে নিজের টাকার সুখ অনন্য। চাইলেই সে টাকা দান করা থেকে শুরু করে প্রিয়জনকে উপহার দেবার মতো সব করা সম্ভব। শুধু সহধর্মিণী না হয়ে সকল নারীর হওয়া উচিত সহযোদ্ধা। বিবাহের পর সংসারের সকল খরচ একা পুরুষ কেন সামলাবে? একজন নারী যদি সমান অধিকার হিসেবে চাকরি করতে পারে তবে সেই সমান অধিকার হতে তার অবশ্যই সংসারের হাল ধরা উচিত। শুধু পরিবারের পুরুষ সদস্যদের উপর কখনোই সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করা উচিত নয়। আমি চাই সকল নারী হোক শিক্ষিত, শক্ত, আত্মনির্ভরশীল এবং স্বাবলম্বী।
নুসরাত তাহসিন রাএী,
শিক্ষার্থী ও নারী উদ্দোক্তা
সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগ
গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাভার
নারী শব্দটি যখন আমাদের মাথায় আসে তখন প্রথমত আমাদের চোখে ভাসে মা,বোন কিংবা স্ত্রীর কথা। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাওয়া অথবা কাজ থেকে ফিরে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা কোন না কোনো নারীর সংস্পর্শে থাকি সেটা হোক কর্মক্ষেত্রে অথবা ব্যাক্তিগত সম্পর্কে। একজন নারী পরিবারে, সমাজ ও দেশে মর্যাদাপূর্ণ ভূমিকা রাখে তাই তার যথাযথ সম্মান ও কাজের সুবিধা প্রদান করা আপনার আমার দায়িত্ব।
অনেকেই আমরা মনে করি কোমলপ্রাণ নারীরা শুধুমাত্র ঘরেই আবদ্ধ থাকবে তাদের কাজ পরিবার সামলানো কিন্তু ইতিমধ্যে সেই গন্ডি পেরিয়ে আজ নারীরা অনেক এগিয়ে, তারা দেখিয়েছে তারা পারে, প্রতিটা ক্ষেত্রে তাদের কাজ অবিশ্বাস্য।
আজ বলব বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর মায়ের কথা, একজন নারী যোদ্ধার কথা।
ক্লাস শেষ করে যখন তপ্ত দুপুরে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেব ভাবছি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাদাম তলায় বেঞ্চে বসে থাকা চল্লিশোর্ধ্ব একজন মহিলাকে চোখে পড়লো,আগ্রহবসত কাছে গিয়ে বসি। আলাপকালে জানতে পারি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন।
কথায় বিনয়ী ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম কার জন্য অপেক্ষা করছেন? উত্তরে বলেন, তানার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র। প্রতিদিন ছেলেকে সাথে নিয়ে আসেন এবং সাথে করে নিয়ে বাড়ি যান।
অল্পতেই আপন হয়ে গেলো মহিলাটি, আলাপ জমতে শুরু করেছে। টুকটাক গল্প শেষে তানার জীবন গল্পে প্রবেশ করলেন।
২০ বছর আগে স্বামী মারা যায়, সেখান থেকেই তিন সন্তানকে বাবার শাসন, আদরে লালন-পালন করছেন। বাবার অভাব বুঝতে দেননি কখনো। স্কুলে শিক্ষাকতা পাশাপাশি সংসার এবং সন্তান সামলিয়েছে সমান তালে। তিন সন্তান নিয়ে একাই লড়ে গেছেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমস্যার ও সম্মুখীন হয়েছেন কিন্তু থেমে যাননি।
মহিলাটির স্বামীর চাকরি সুত্রে মহিলাটি দেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরেছেন আর তানার স্বামী সবসময় সাহায্য করতেন সাহস দিতেন। যা আজ-অব্দি মহিলাটির তিন সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা ও শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
সমাজে অনেকেই আছে যারা বউয়ের প্রশংসা করতে লজ্জাবোধ করে। আমাদের সমাজে নিজের স্ত্রীর প্রশংসা করার অভ্যাস টা খুব কম। আবার কারো বউ যদি কোনো বিষয়ে কারো চেয়ে একটু উপরে থাকে তা মেনে নেওয়া কিংবা জনসম্মুখে প্রকাশ করাটা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব কিন্তু এই ছোট মন মানুষিকার পরিবর্তন আর একটু সহযোগিতা একজন নারীর জন্য কতোবড় শক্তি হয়ে উঠতে পারে ও কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা আপনারা একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন, আমি তা দেখেছি ওই মহিলাটির চোখে সেটা ছিলো কতোটা শ্রদ্ধাপূর্ণ আবেগঘন মূহুর্ত।
আপনার সহধর্মিণী বা সহকর্মীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়ান। মনকে প্রসারিত করুন। বৈষম্যের দৃষ্টি বর্জন করুন। আপনার সহধর্মিণী যদি চাকরিজীবী হয় তার কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন তাকে সাহায্য করুন তার শারিরীক ও মানুষিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখুন। সব মেনে নিয়ে তাকে প্রশংসা করতে হিংসাবোধ কিংবা ছোট অনুভূত হবেন না। কারণ সে আপনার পরিবার ও দেশের সম্পদ। সে আপনার চেয়ে ভালো করলে বরং গর্ব করে বলুন। তার জন্য বাঁধা না হয়ে বরং এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা হন। এগুলোই একমাত্র পারে সমাজে নারী অবস্থানের উন্নয়ন ঘটাতে।
সাদিয়া রহমান তন্বী
শিক্ষার্থী
ইংরেজি বিভাগ
গণ বিশ্ববিদ্যালয়
আজ বিশ্ব নারী দিবস। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আমরা আজ অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছি । কিন্তু আজও আমাদের নারীদের ঘরের বাইরের কাজকে আমাদের সমাজ ভালো চোখে দেখে না। আমি একজন জলবায়ু যোদ্ধা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি ২০২১ সাল থেকে। ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ ও ইয়ুথনেট আয়োজিত একটি ট্রেনিং অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার এই যাত্রাটা শুরু হয়। একজন নারী হিসেবে আমার এই যাত্রাটাও সহজ ছিলো না। পারিবারিক বাধা, সামাজিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে প্রতিনিয়ত । কিন্তু একটা সময় আমার অদম্য ইচ্ছার কাছে সেইসব বাধা টিকতে পারে নি। এর থেকে আমি মনে করি একজন নারী যদি সৎ থাকে এবং নিজের ইচ্ছে শক্তিতে অটল থেকে সঠিক ভাবে কাজ করে যায় তাহলে একদিন নিশ্চিত সে সফল হবে। আল্লাহ ছাড়া তার সফলতার পথ কেউ রূদ্ধ করতে পারবে না। তাই পরিশেষে বলবো যেহেতু আমি জলবায়ু নিয়ে কাজ করছি আমি স্বপ্ন দেখি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমি রেখে যেতে চাই একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী। পৃথিবীর সকল নারীকে জানাই নারী দিবসের শুভেচ্ছা। এগিয়ে চলুক সবাই সবার জায়গা থেকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।
হুমায়আরা আহমদ জেবা
শিক্ষার্থী ও জলবায়ু কর্মী
এম. সি. কলেজ সিলেট
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নারীরা আজ পৌঁছে গেছেন বিমানের ককপিট থেকে পর্বতশৃঙ্গে। দশভুজা নারী ঘরে-বাইরে নিজেকে আলোকিত করছেন প্রজ্ঞা আর মেধায়। নারী স্বাধীনতার মূল বিষয়গুলো শুধু গ্রন্থেই বন্দী হয়ে থাকার জন্য নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার প্রতিফলন জরুরি। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আমরা অনেকেই উঁচু গলায় নারী স্বাধীনতার কথা বলে থাকি, কিন্তু আমরা আসলে নারী স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বুঝি না। সমাজকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, নারীর প্রথম পরিচয় হচ্ছে সে মানুষ। তাই নারী জ্ঞান অর্জন, আত্মসংযম, শ্রমনিষ্ঠা, সেবা, দৃঢ়তা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে মানসিক দাসত্বের কঠিন শৃঙ্খল ভেঙে এগিয়ে চলতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নির্যাতিত সকলের আত্মসম্মানবোধের চেতনা জাগ্রত হোক, মানুষ হিসেবে সবাই সম্মানিত হোক, সকলের অধিকার পূর্ণতা পাক।
নাম:তামান্না তানজিন
শিক্ষার্থী,
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ
প্রেক্ষাপট :
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ এই দিনটির শুরু। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সুঁচ কারখানার নারী শ্রমিকরা দৈনিক শ্রম ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। আন্দোলন করার অপরাধে গ্রেপ্তার হন বহু নারী। কারাগারে নির্যাতিত হন অনেকেই। তিন বছর পরে ১৮৬০ সালের একই দিনে গঠন করা হয় ‘নারী শ্রমিক ইউনিয়ন’। ১৯০৮ সালে পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবিতে আন্দোলন করেন। অবশেষে আদায় করে নেন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার অধিকার। ১৯১০ সালের এই দিনে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মানির নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই সারা বিশ্বে দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। এর দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
সুত্র,গুগল