দেশের হারানো গৌরব আর সম্মান ফিরিয়ে আনার প্রত্যয়ে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে আসীন হন জো বাইডেন। দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বয়সী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন ৭৮ বছর বয়সী এই ডেমোক্র্যাট। নির্বাচনি প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পের প্রথম শাসনামলে ভেঙ্গে পড়া যুক্তরাষ্ট্রকে ফের বিশ্বের পরাশক্তিতে পরিণত করবেন। সে প্রতিশ্রুতি কতখানি রাখতে পারলেন বাইডেন? নিজ লক্ষ্যে কতটুকু সফল হতে পেরেছেন এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট?
গেল নভেম্বরে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে জোর প্রচার চালান বাইডেন। তবে ভোটের মাস দুই আগে নির্বাচন থেকে সরে আসার আকস্মিক ঘোষণা দেন এই ডেমোক্র্যাট। তার উত্তরসূরি হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসকে মনোনয়ন দেয় ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাট শিবির। তবে গেল ভোটে রিপাবলিকান ট্রাম্পের কাছে ভরাডুবি হয় কামালার।
ভাইস প্রেসিডেন্টকে হারের দায় সরাসরি না দিলেও আফসোস যেন পিছু ছাড়ছে না বাইডেনের। তার ধারণা, সরে না গিয়ে নির্বাচন করলে ট্রাম্পকে সহজেই হারিয়ে দিতেন তিনি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে ভোটে এলেও কি বাইডেন তার ধারণা মত জয় পেতেন? দ্বিতীয় মেয়াদে বসতে পারতেন দেশ পরিচালকের আসনে?
এ প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে বাইডেনের সফলতা-ব্যর্থতার মাপকাঠি। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কতটা উৎরে গেছেন এই ডেমোক্র্যাট, সে হিসেব করলেই পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় সাধারণ অ্যামেরিকানদের মধ্যে বাইডেনের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা।
কথা ছিল করোনায় ক্ষত-বিক্ষত দেশ পুনর্গঠন করবেন জো বাইডেন। অর্থনীতির ধকল কাটিয়ে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় নজিরবিহীন ভূমিকা রাখবে তার প্রশাসন। জনগণের বিভেদ মিটিয়ে সবাইকে একতাবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন বাইডেন।
কিন্ত জো বাইডেনের শাসনামল এগিয়েছে ঠিক এর বিপরীতে। গত চার বছরে নজিরবিহীন সংঘাতের মধ্যপ্রাচ্য দেখেছে বিশ্ব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে উত্তাপ ছড়িয়েছে ইউরোপেও। যুদ্ধ-বিগ্রহে বেহিসেবি অর্থকড়ি ছড়িয়ে নিজ দেশে বাড়িয়েছেন মূল্যস্ফীতি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বেকারত্ব। তীব্র সমালোচনা, বিক্ষোভ, কঠোর ছাত্র আন্দোলনের মুখে নাকাল হয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
তার ক্ষমতার সবচেয়ে বিব্রতকর বিষয় হিসেবে ধরা হয় আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার। ট্রাম্পের আমলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হন বাইডেন। সব মিলিয়ে খুব একটা সুখকর ছিল না বাইডেনের আমল। এর জেরেই জনপ্রিয়তার পারদে নামতে থাকেন বাইডেন। ৫৬ শতাংশ জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতা নেয়া বাইডেনের জনপ্রিয়তা কমে দাঁড়ায় ৪৩ শতাংশে।
ভাটা পড়তে থাকা এই জনপ্রিয়তায় যেন শেষ পেরেক ঠুকে দেয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থ কূটনীতির কারণে প্রায় তিন বছরেও মধ্যস্থতা হয়নি সে যুদ্ধে। বাইডেন তার অবশিষ্ট গ্রহণযোগ্যতাটুকুও হারিয়ে ফেলেন ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে। ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের নামে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের যেন বৈধতাই দিয়ে গেছে বাইডেন নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। হামাস নির্মূলের নামে অবরুদ্ধ উপত্যকার প্রায় ৪৭ হাজার মানুষ নিশ্চিহ্ন হলেও থামেনি তেলআবিবকে ওয়াশিংটনের অস্ত্র সহায়তা। বরং রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে বাইডেনের ইসরায়েলপ্রীতি।
তার আমলে দুর্বল হয়ে পড়ে দেশটির বাণিজ্য নীতিও। দুরত্ব বাড়ে চীন, ভারত, রাশিয়া, মেক্সিকোর মতো বাণিজ্যে শক্তিশালী দেশগুলোর সাথে। দুর্বল সীমান্ত নীতি অনুসরণ করে চারবছরে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেন জো বাইডেন। তার আমলেই যুক্তরাষ্ট্রে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে অবৈধ অভিবাসন। সেই সাথে বেড়েছে অভিবাসনজনিত অপরাধের ঘটনাও।
বয়স বিতর্কে ক্ষমতার শুরু থেকেই জর্জরিত ছিলেন জো বাইডেন। এবারের নির্বাচনে যেন সেই বিতর্কেই নতুন করে জড়াতে হয়েছে তাকে। প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেটে ট্রাম্পের কাছে লজ্জাজনক হারে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েন তিনি। শেষমেষ বয়সের কাছে হার মেনে প্রত্যাহার করে নেন প্রেসিডেন্টের প্রার্থিতাও।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নানা ইস্যু, আন্তর্জাতিক পররাষ্ট্রনীতির পাশাপাশি নিজের বয়স— সব মিলিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অনেকটা মিশেলে অভিজ্ঞতা নিয়ে দায়িত্ব ছাড়ছেন বাইডেন। কাজেই তিনি সফল না ব্যর্থ সে হিসেব অনেকটাই পরিষ্কার রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কাছে।
টিএ/