রাজার স্থান রাজশাহী

রাজশাহী বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের একটি শহর। বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শহরটি বিখ্যাত পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। প্রাচীন বাংলার বেশ কয়েকটি রাজধানী এই এলাকাতেই ছিল। এদের মাঝে লক্ষণৌতি বা লক্ষণাবতি, পুণ্ড্র ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। রাজশাহী তার আকর্ষণীয় রেশমীবস্ত্র, আম, লিচু এবং মিষ্টান্ন সামগ্রীর জন্য প্রসিদ্ধ। রেশমীবস্ত্রের কারণে রাজশাহীকে রেশমনগরী নামে ডাকা হয়।

ভৌগলিক অবস্থান ও আয়তন

রাজশাহী জেলার অবস্থান পদ্মার উত্তর তীরে। ২৪ ডিগ্রি ০৭ মিনিট হতে ২৪ ডিগ্রি ৪৩ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ এবং  ৮৮ ডিগ্রি ১৭ মিনিট হতে ৮৮ ডিগ্রি ৫৮ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।

এর আয়তন প্রায় ২৪০৭.০১ বর্গ কিলোমিটার। এই জেলায় ২৩ লাখ ৭৭ হাজার ৩১৪ জন (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী) মানুষের বসবাস।

হযরত শাহ্ মখদুম রুপোশ (রহ.) এর মাজার শরীফ, রামচন্দ্রপুর দেবীশিংপাড়ায় মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলের স্থাপত্য কীর্তি রাজশাহীকে প্রাচীনতম প্রমাণ করে। সে সূত্রে বলা হয়, রাজশাহী শহরের বয়স প্রায় পৌনে চারশ বছর।

রাজশাহীর ইতিহাস

রাজশাহী সুপ্রাচীন ঐতিহ্য মণ্ডিত একটি শহর। অনেক আগে থেকে এই শহরটি প্রাচীন বাংলায় পরিচিত ছিল।

প্রাচীন ও মধ্যযুগ

রাজশাহী ছিল প্রাচীন বাংলার পুণ্ড্র সাম্রাজ্যের অংশ। বিখ্যাত সেন বংশের রাজা বিজয় সেনের সময়ের রাজধানী বর্তমান রাজশাহী শহর থেকে মাত্র ৯ কিমি দূরে অবস্থিত ছিল। এ শহরের প্রাচীন নাম ছিল মহাকাল গড়। পরে মধ্যযুগে বর্তমান রাজশাহী পরিচিত ছিল রামপুর বোয়ালিয়া নামে । এর সূত্র ধরে এখনও রাজশাহীর একটি থানার নাম বোয়ালিয়া।

নবাবী আমল

বাংলার নবাবী আমল ১৭০০ হতে ১৭২৫ সালে নবাব মুশির্দকুলী খান সমগ্র বাংলাদেশকে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেন। যার মধ্যে ‘চারুলা রাজশাহী’ নামে একটি বৃহৎ বিস্তৃতি এলাকা নির্ধারিত হয়। সমগ্র রাজশাহী ও পাবনার অংশ নিয়ে এই চাকলা গঠিত হয়েছিল। পদ্মার উত্তরাঞ্চল বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে পাবনা পেরিয়ে ঢাকা পর্যন্ত এমনকি নদীয়া, যশোর, বর্ধমান, বীরভূম নিয়ে এই এলাকা রাজশাহী চাকলা নামে অভিহিত হয়।

ব্রিটিশ আমল

ব্রিটিশ রাজত্বের সময় রাজশাহী বোয়ালিয়া নামে পরিচিত ছিল। তখন এটি ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসাম অঞ্চলের অন্তর্গত রাজশাহী জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র। রাজশাহীকে সে সময়ে রেশম চাষের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল। তখন রাজশাহীতে একটি সরকারি কলেজ ও রেশম শিল্পের জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। সেসময় থেকে দেশবিভাগের পূর্ব পর্যন্ত পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে প্রতিদিন যাত্রীবাহী স্টিমার চলাচল করত।

১২ জুন ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে রাজশাহী শহরের বেশীরভাগ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে অনেক ভবন আবার নতুন করে স্থাপিত হয়।

আধুনিক যুগ

রাজশাহী শহরকে কেন্দ্র করে ১৭৭২ সালে জেলা গঠন করা হয়। ১৮৭৬ সালে গঠিত হয় রাজশাহী পৌরসভা। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয়।

রাজশাহী নামকরণ

রাজশাহী নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই কয়েক শতাব্দী পূর্বে ফিরে যেতে হয়। এ শহরের প্রাচীন নামটি ছিল মহাকাল গড়। পরে রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়ায় রামপুর-বোয়ালিয়ায়। রামপুর-বোয়ালিয়া শহরের নামকরণ রাজশাহী কী করে হলো তা নিয়ে প্রচুর মতপার্থক্য রয়েছে।

রামপুর-বোয়ালিয়া থেকে রাজশাহী নামটির উদ্ভব কিভাবে হলো এর সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নাই। ব্রিটিশ আমলের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসে ও রাজশাহী নামক কোনো জনপদ বা স্থানের উল্লেখ নাই। অনেকে মনে করেন, এই জনপদ একদা বহু রাজা, সুলতান আর জমিদার শাসিত ছিল বলে নামকরণ হয়েছে রাজশাহী।

ঐতিহাসিক ব্লকম্যানের (Bolch Mann) মতে, খ্রিষ্টীয় ১৫শ শতকে রাজা গণেশের দখলের সময় থেকে রাজশাহী নামের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু ব্লকম্যানের অভিমত গ্রহণে আপত্তি করে বেভারিজ (Beveridge) বলেন, রাজা গণেশের সময় এই নামটির উদ্ভব হলে তার উল্লেখ টোডরমল প্রণীত খাজনা আদায়ের তালিকায় অথবা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী নামক গ্রন্থে অবশ্যই পাওয়া যেত। ডব্লিউ হান্টারের মতে, নাটোরের রাজা রামজীবনের জমিদারী রাজশাহী নামে পরিচিত ছিল এবং সেই নামই ইংরেজরা গ্রহণ করে এই জেলার নাম দেন রাজশাহী।

অনেকে এসব ব্যাখ্যাকে যথার্থ ইতিহাস মনে করেন না। তবে ঐতিহাসিক সত্য যে, নবাব মুশির্দকুলী খান এই অঞ্চলকে চারুলা রাজশাহী নামে একটি বৃহৎ বিস্তৃতি চাকলা নির্ধারণ করেন। প্রথমে সমগ্র চাকলার রাজস্ব আদায় করতেন হিন্দু রাজ-জমিদার উদয় নারায়ণ। তিনি ছিলেন মুর্শিদ কুলির একান্ত প্রীতিভাজন ব্যক্তি। যে জন্য নবাব তাকে রাজা উপাধী প্রদান করেন। অনেকের মতে, প্রথম রাজা উদয় নারায়ণের ওপর প্রীতিবশত এই চাকলার নাম স্থায়ীভাবে রাজশাহী করেন নবাব মুর্শিদকুলী খান। ১৭১৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খান নাটোরের রামজীবনের নিকট বন্দোবস্ত প্রদানকালে বন্দোবস্তে রাজশাহী নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

কিন্তু ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়ের মতে, ১৭৩০ সালে রামজীবন মারা গেলে তার দত্তক পুত্র রামকান্ত রাজা হন। ১৭৫১ সালে রামকান্তের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী ভবানী দেবী রাণী ভবানী নামে উত্তরাধীকারী লাভ করেন। এই জমিদারি পরে নাটোরের রাণী ভবানীর শাসনে আসে ও বহু অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃতি লাভ করে। পরে রাণী ভবানীর দেয়া নামই রাজশাহীর নামকরণ করা হয়। অবশ্য রাণী ভবানী সম্পর্কে গ্রান্ট লিখেছিলেন যে, রাণী ভবানীর জমিদারিকেই রাজশাহী নামে ডাকা হতো। সেখান থেকেই রাজশাহী জেলার নামকরণ।

তবে সাধারণভাবে রাজশাহী শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দুটি ভিন্ন ভাষার একই অর্থবোধক দুটি শব্দের সংযোজন পরিলক্ষিত হয়। সংস্কৃত ‘রাজ’ ও ফারসি ‘শাহী’ শব্দযোগে ‘রাজশাহী’ শব্দের উদ্ভব। দুইটি শব্দের অর্থই রাজা বা রাজকীয় বা বাদশাহ বা বাদশাহী। বাংলা ভাষায় আমরা একই অর্থের অনেক শব্দ দু-বার উচ্চারণ করে থাকি। যেমন– শাক-সবজি, চালাক-চতুর, ধার-দেনা, ঘষা-মাজা, মান-সম্মান, পাহাড়-পর্বত, পাকা-পোক্ত, বিপদ-আপদ ইত্যাদি। ঠিক তেমনি করে এই রাজশাহী শব্দের উদ্ভবও হয়ে থাকতে পারে।

রাজশাহী শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের অনেকগুলির খ্যাতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। নামকরা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য রাজশাহী শহর শিক্ষানগরী নামেও পরিচিত। রাজশাহী শহরে এবং এর আশেপাশে বেশ কিছু বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক মসজিদ, মন্দির ও উপাসনালয় তথা ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে।

 

টাইমস/এএস/এসআই

Share this news on: