হিরু অনোদা: হার না মানা এক জাপানি সৈনিকের গল্প

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে ৬ যুগ আগে। কাগজে কলমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলেও পরবর্তি ৩০ বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন এক জাপানি। তাঁর নাম হিরু অনোদা।

হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমানবিক বোমা হামলার পর ২য় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণ যখন প্রায় নিশ্চিত। তখনও প্রায় ৩,৬০০ জাপানি সৈনিক দেশটির রাজা হিরোহিতোর ঘোষণা মেনে নিয়ে যুদ্ধ থেকে ফিরে আসেননি।

ধারণা করা হয়, এদের বেশির ভাগই বিশ্বাস করতেন না যে, যুদ্ধ আসলে শেষ হয়ে গেছে। তাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে তারা গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এদেরই একজন হিরু অনোদা। যিনি যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও প্রায় ৩০ বছর ধরে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। তিনি আত্মসমর্পণ করেন ১৯৭৪ সালের ১৬ মে।

জাপানি ইন্টেলিজেন্স অফিসার হিরু অনোদা ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপের সুগি বিগ্রেডে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে মিত্র বাহিনী দ্বীপটি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বিমান ও যুদ্ধ জাহাজ থেকে জাপানি সেনাদের অবস্থানে বোমা হামলা শুরু করে। জাপানি সেনারা পিছু হঠতে বাধ্য হয়।

হিরু অনোদার নেতৃত্বে ৪ জনের একটি দলকে দ্বীপে অবস্থান নিয়ে গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। তার কমান্ডিং অফিসার মেজর ইয়োসিমি তানিগুচি তাকে ‘আত্মসমর্পণ এবং আত্মহত্যা না করে’ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। যাইহোক না কেন জাপানি সেনারা তাদেরকে উদ্ধারের জন্য দ্বীপটিতে ফিরে আসবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন ।

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তানিগুচি এবং তার সৈন্যরা কিছুদিনের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এ খবর হিরু অনোদা’র ক্ষুদ্র গেরিলা দলটির কাছে পৌঁছায়নি।

হিরু অনোদা এবং তার দলের বাকী ৩ সদস্য দ্বীপটির পাহাড়ে লুকিয়ে থেকে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে বিচ্ছিন্ন জাপানি সেনাদের আত্মসমর্পণের খবর পৌঁছে দিতে দ্বীপটিতে আমেরিকান বি-১৭ বিমান থেকে লিফলেট ছড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তুখোড় ইন্টেলিজেন্স অফিসার হিরু অনোদা এসব লিফলেটকে আমেরিকান প্রোপাগান্ডা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

লুকিয়ে থাকা অবস্থায় অনোদা এবং তার দলের অন্য সদস্যরা বিভিন্ন সময় আশেপাশের গ্রামগুলোতে গেরিলা হামলা চালিয়েছে। বেশ কয়েকবার ফিলাপাইন পুলিশের সাথে খণ্ডযুদ্ধও হয়েছে তাদের। ১৯৪৯ সালে দলটির একজন সদস্য ইউইচি আকাতসু দলত্যাগ করে পালিয়ে যায় এবং ১৯৫০ সালে ফিলিপাইন পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

১৯৫২ সালে বিমান থেকে পরিবারের চিঠি ও ছবি ফেলে দলটিকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু ৩ জনের গেরিলা দলটি এই ঘটনাকে শত্রুপক্ষের কৌশল মনে করে আত্মসমর্পণ থেকে বিরত থাকে। ১৯৫৪ সালে দলটির একজন সদস্য ‘সিমাদা’ স্থানীয়দের সাথে গোলাগুলির সময় মারা যান।

কিন্তু অদম্য হিরু অনোদা তার গেরিলাযুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। সর্বশেষ সঙ্গী কজুকাকে সাথে নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে অগ্নি-সংযোগ, লুটপাট, হত্যা চালিয়ে যান। ১৯৭২ সালের ১৯ অক্টোবর স্থানীয় পুলিশের গুলিতে অনোদার সর্বশেষ সঙ্গী কজুকাও নিহত হয়। এবার একাই গেরিলাযুদ্ধ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন অনোদা।

১৯৭৪ সালে  দ্বীপটিতে হিরু অনোদার সাথে জাপানি নাগরিক  নোরিও সুজুকির দেখা হয়। সুজুকি অনোদার খোঁজেই দ্বীপটিতে এসেছিলেন। সুজুকির সাথে অনোদার বন্ধুত্ব হয়, কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ ছাড়া অনোদা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন।

সুজুকি অনোদার সাথে তোলা একটি ছবি প্রমাণ হিসেবে সাথে নিয়ে জাপানে ফিরে আসেন। জাপান সরকার অনোদাকে ফিরিয়ে আনতে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেজর ইয়োসিমি তানিগুচিকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়। তানিগুচি ততদিনে একজন পুরাদস্তুর বই বিক্রেতা হিসেবে জীবন নির্বাহ করছেন।

অবশেষে ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ তানিগুচি লাবাং দ্বীপে আবারও ফিরে আসেন। অনোদাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ প্রদান করেন তিনি।

২৯ বছরের গেরিলাযুদ্ধ শেষে হিরু অনোদা ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলাতে দেশটির প্রেসিডেন্ট মার্কোজের কাছে তার ‘আরিসাকা টাইপ নাইন্টি নাইন রাইফেল’, ৫০০ রাউন্ড গুলি, বেশ কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড ও একটি ছুরিসহ আত্মসমর্পণ করেন। প্রেসিডেন্ট মার্কোজ অনোদাকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তথ্যসূত্র: দ্যা গার্ডিয়ান, এবিসি.নেট এবং উইকিপিডিয়া

 

টাইমস/এনজে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
রাজধানীতে ডিএনসিসির মশক নিধন অভিযান শুরু Jul 02, 2025
img
সোমালিয়ায় বিমানবন্দরে সামরিক হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত Jul 02, 2025
img
১৮ মিনিটেই মিয়ানমারের জালে বল, ১-০ তে এগিয়ে বাংলাদেশ Jul 02, 2025
img
শাহরুখের নামে ‘কুকুর পালা’ বিতর্কে জবাব দিলেন আমির খান Jul 02, 2025
img
জুলাই পদযাত্রায় এনসিপি নেতাদের কাঁঠাল খাইয়ে আপ্যায়ন করলেন কৃষক Jul 02, 2025
img
কোরিয়ান অভিনেত্রী লি সিও-ই আর নেই Jul 02, 2025
img
ডর্টমুন্ড-রিয়াল ম্যাচে দেখা হচ্ছে না বেলিংহাম ভাইদের Jul 02, 2025
img
বেবিচকের নতুন চেয়ারম্যান মোস্তফা মাহমুদ Jul 02, 2025
img
সাবেক সিইসি নুরুল হুদার জামিন নামঞ্জুর Jul 02, 2025
img
শিক্ষার্থী ভিসায় ‘সময়সীমা’ আরোপ করতে চান ট্রাম্প Jul 02, 2025
img
শিক্ষার্থীদের আঘাত করার পরিণতি ভালো হবে না : নাহিদ Jul 02, 2025
img
যে কারণে প্রথম ওয়ানডেতে মাঠে নেই রিশাদ Jul 02, 2025
img
৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ পালন না করার সিদ্ধান্ত Jul 02, 2025
img
৫ আগস্ট সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা Jul 02, 2025
img
সব সময় দর্শকদের মনে বেঁচে থাকতে চাই : সাফা কবির Jul 02, 2025
img
দাম কমলো এলপি গ্যাসের Jul 02, 2025
img
ফারিণের এক নম্বর স্বামীর খোঁজ জানতে চাইলেন নিশো Jul 02, 2025
img
পুত্রের জন্মসনদে ধর্ম ‘ফাঁকা’ রেখে সমাজকে নতুন বার্তা দিলেন বিক্রান্ত ম্যাসি Jul 02, 2025
img
শুরুতেই সাকিব-তাসকিনের বোলিং তোপে লঙ্কানরা Jul 02, 2025
img
আর্সেনালে যোগ দিলেন বিশ্বের সবচেয়ে দামি গোলকিপার Jul 02, 2025