বান্দরবানে শুটিং নিয়ে অভিনেতা খরাজ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ

টলিপাড়ার জনপ্রিয় অভিনেতা খরাজ মুখোপাধ্যায়। তিনি কেবল পর্দায় দুর্দান্ত অভিনয় করেন তা-ই নয়, বাস্তবেও তিনি মজার মানুষ। নানা অভিজ্ঞতা জমিয়ে রাখেন, আর সময় পেলেই সেগুলো ভাগ করে নেন দর্শকদের সঙ্গে। 

সম্প্রতি খরাজ তার ফেসবুকে একটি ভিডিও শেয়ার করে বললেন, বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। বাংলাদেশে অঙ্গার ছবির শুটিং করতে গিয়েছিলাম। ওখানকার বান্দরবান এলাকায় শুটিং হয়েছিল। আমার ধারনা ছিল, বান্দারবন বকখালি, কাকদ্বীপের মতোই দেখতে হবে। যেখানে সমতল সমুদ্রে মিশে যাচ্ছে। কিন্তু ওখানে পৌঁছে দেখলাম বান্দরবান এলাকাটা তেমন নয়। বরং একটা পাহাড়ি অঞ্চল। জায়গাটা খুবই উঁচু। সেখানেই শুটিং হবে। সেখানেই একটা বাড়ির সেট তৈরি করা হয়েছিল। মনোরম জায়গা, চারপাশে প্রচুর গাছপালা।

খরাজ জানালেন, এই শুটিংয়ে আমাদের একজন প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিল, নাম উজ্জ্বল। উজ্জ্বল একটু প্রয়োজনের বেশি কথা বলে। যার কারণে অনেক কিছুই ভুলভাল বলে।

‘‘আমরা যেদিন বান্দরবান যাচ্ছি,সেদিন উজ্জ্বল আমাকে বলল, ‘দাদা খুব সাবধান। এই জায়গায় কিন্তু প্রচুর পুলিশ এবং সেনাবাহিনী থাকে। সেনাবাহিনী সব সময় টহল দিতে থাকে। খুব সাবধান। এসব জায়গাতে বেশি কথা বলা যাবে না কিন্তু। আমাদের সময় মতো নেমেও চলে আসতে হবে। একদম মাপা টাইম। শুটিং সেরে সময়মতো নেমে আসতেই হবে।’’

আমি উজ্জ্বলকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওখানে টয়লেট আছে তো? উজ্জ্বল বলে উঠল, ওটা নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এতক্ষণের কাজ, যদি টয়লেট যেতে হয় তাহলে! আমাকে পাল্টা উজ্জ্বল বলল, একটা জায়গা ঘিরে দেওয়া হবে। সেখানেই যেতে হবে। উজ্জ্বলের মুখে এমন কথা শুনে আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। এতক্ষণের শুটিং, যদি টয়লেট পেয়ে যায়, কী হবে? আমাদের সমস্য়ার থেকেও বেশি, মহিলারা কী করবে? এই ছবির নায়ক ছিলেন ওম। আর নায়িকা বাংলাদেশের। একেবারেই নতুন। এটাই ছিল তার প্রথম ছবি। দুই চারদিন ধরে সিনেমার শুটিং চলে।

খরাজের কথায়, প্রথমদিন শুটিং করতে যাচ্ছি। গাড়িটা পাহাড়ি রাস্তা ধরে উপরে উঠছে। কিছুটা যাওয়ার পর আমি উজ্জ্বলকে বললাম, আমার টয়লেট পেয়েছে। উজ্জ্বল আমাকে বলল, একদম না দাদা। খবরদার না। আমি তো অবাক। বলেই ফেললাম, এর মানে কী? উজ্জ্বল বলেই চলল, গাড়ি থেকে একদম নামা যাবে না। আমি বললাম, কেন? উজ্জ্বল বাঙালি ভাষায় আমাকে বলতে শুরু করল, আপনাকে বললাম না, বুঝতে পারছেন না! গাড়ি থেকে নামলেই সেনারা গুলি করে দেবে! আমি ভাবতে শুরু করলাম, এতো মহামুশকিলে পড়া গেলাম! টয়লেট পেয়েছে, কী করব!

আরেকটু উপরে ওঠার পর, টয়লেট আর চেপে রাখতে পারছিলাম না। আবার উজ্জ্বলকে বললাম, গাড়ি থামাতে। চোখ বড় বড় করে উজ্জ্বল আবার বলল, একদম না। আপনি বুঝতেই পারছেন না কী বলছি, ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না কেন? এখানে বলে রাখি, উজ্জ্বলের গায়ের রং খুব কালো ছিল। তাই আমরা সবাই কালি বলেই ডাকতাম।

এরপর খরাজ জানালেন, আমাদের গাড়ি একটা চেকপোস্টের সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে সেনারা এসে গাড়ির নানা কাগজপত্র পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখছে। আমি তখন ভাবছি, এই সময় যদি গাড়ি থেকে নেমে টয়লেটটা করা যেত, তাহলে খুব ভালো হত।

ওই চেকপোস্টের যিনি দায়িত্বে, সেই অফিসার হঠাৎ মোটা গলায় গাড়ির সামনে এসে জিজ্ঞাসা করছেন, গাড়িতে কে কে আছেন? উজ্জ্বলকে জিজ্ঞাসা করতেই উজ্জ্বল জানালেন, আমরা কারা, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। আমি গাড়ির সামনের সিটে বসে ছিলাম। আমার দিকে সেই সেনাকর্মকর্তার চোখ পড়তেই বলে উঠলেন, আপনি এখানে কী করছেন? আমি বললাম, এই ছবিতে আমিও অভিনয় করছি। শুটিং করতে যাচ্ছি।

সঙ্গে সঙ্গে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ইন্ডিয়ায় থাকেন না? আমি হ্যাঁ বলতেই, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলল, গাড়ি থেকে নামুন। আমি তো ভাবলাম, কী অপরাধ করলাম? যে আমাকে এভাবে গাড়ি থেকে নামতে বলছে!

আমি গাড়ি থেকে নামলাম। তারপর অফিসার আমাকে বললেন, চলুন আমার সঙ্গে। আমি বললাম কেন? অফিসার বললেন, আমি বলছি যখন, তখন চলুন। তারপরই হঠাৎ করে অফিসার বলেন, চলুন না, আমার সঙ্গে এককাপ কফি খেয়ে তারপর শুটিংয়ে যাবেন। সেই সুযোগেই আমি বললাম, আমার একটু টয়লেট যেতে হবে। অফিসার বললেন, সে টয়লেট না হয় যাবেন। কফি খাবেন, তারপরই শুটিং করতে যাবেন। আমি জানালাম, এতে শুটিংয়ের দেরি হবে। বরং শুটিং সেরে সন্ধ্যাবেলায় ফেরার সময় কফি খাব। অফিসার তো নাছোড়বান্দা। আমার হাত ধরে কফি খাওয়ার অনুরোধ করেই যাচ্ছেন। আমি বললাম, আমি কথা দিচ্ছি, ফেরার সময় আমি নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে কফি খাব। আপাতত, এখন আমি টয়লেটে যেতে পারি? হঠাৎই শুনতে পেলাম, উজ্জ্বলকে ব্যঙ্গ করে সবাই গাইছে, ব্যাটার নাকে কালি, ব্যাটার মুখে কালি। তারপর টয়লেট করে এসে, আবার অফিসারকে বললাম, আমি ফেরার সময় অবশ্য়ই কফি খাব আপনার সঙ্গে। তারপর অফিসার আমাকে বলেন, শুটিংয়ের সময় কোনও অসুবিধা হলে চলে আসবেন। ঘরের ব্যবস্থা করে দেব। শুয়ে থাকবেন এখানে।

খরাজ এই ভিডিওতে আরও বলেন, সেই সুযোগে আমি অফিসারকে বলেই ফেললাম, আচ্ছা, ওখানে শুটিং করার সময়টা তো খুবই মাপা। যদি একটু বেশি সময় লাগে, ৭টার বদলে যদি সাড়ে ৭টা হয়ে যায়, তাহলে কি খুব অসুবিধা হবে? অফিসার স্পষ্ট বলেন, না কোনও অসুবিধা নেই, যতক্ষণ খুশি করবেন। রাত ১১টা পর্যন্তও করতে পারেন। আমি আছি তো, নিশ্চিন্তে শুটিং করতে পারেন। তারপর গাড়িতে উঠেই উজ্জ্বলকে একহাত নিলাম, সোজা বললাম, তুই তো কথা বেশি বলিস, তুই তো বলেছিলি সন্ধ্যা ৭টা। আমি দেখ, অফিসারের সঙ্গে কথা বলে, ৭টার বদলে রাত ১০টা, ১১টা করে ফেললাম। শুটিং শেষে ফেরার সময় আমি কথা রেখেছিলাম। সেই অফিসারের সঙ্গে কফিও খেয়েছিলাম। কথায় কথায় জানতে পেরেছিলাম, উনি আমার অভিনীত প্রচুর ছবি দেখেছেন। আমাকে পছন্দও করেন। এরপর যতদিন শুটিং চলেছে, রোজই ফেরার পথে অফিসারের সঙ্গে দেখা করতাম। সেই অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। আসলে সেনাবাহিনী বলতেই সাধারণত অবাঙালিই বেশি দেখেছি। ওখানে গিয়ে ওদের বড্ড আপন লেগেছিল। আসলে একই ভাষায় কথা বলি তো।

এসএম/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ