রাষ্ট্র সামিয়াদের ধর্ষণের দায় এড়াতে পারে কি?

 

গেল মাসে রাজধানীর ওয়ারীতে ৭ বছরের শিশু সায়মা আফরিন সামিয়া ধর্ষণ ও হত্যার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। নারীত্বের বিকাশহীন শিশুর প্রতি এমন নৃশংসতা প্রমাণ করে আমাদের অবক্ষয়ের স্তর কত নীচে নেমে গেছে। দেশে অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।    

দেশে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি হলেও নিরাপত্তায় অনেকটা পিছিয়ে আছে এতে কারো দ্বিমত থাকার কথা না। গত একমাস আগে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে  আলোচনা করলে আমরা এর বাস্তব দিক দেখতে পাই।

ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সাথে যুক্ত হয়েছে শিশুধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনাও। এক ঘটনার জের শেষ না হতেই নতুন করে ঘটনার অবতারণা হচ্ছে।

রাষ্ট্র জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। সফলতা দেখাতে পারছে না। দেশে ধর্ষণসহ অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলেছে। আইনের ত্রুটি, রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্বলতা ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এর জন্য প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হয়।

অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রভাব; আশ্রয়-প্রশ্রয়, রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা ও ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এ জন্য প্রধানত দায়ী। তাই কোনো অজুহাতেই রাষ্ট্র বা সরকার দেশে ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রবণতাসহ সামিয়াদের ধর্ষণের দায় এড়াতে পারে না।

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতাসহ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা যে এখন নিয়ন্ত্রণহীন তা সাম্প্রতিক অপরাধপ্রবণতা পর্যালোচনা করলেই উপলব্ধি করা যায়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের এক জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) দুই হাজার ১৫৮টি শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৯৮৮টি শিশু  বিভিন্ন ধরনের অপমৃত্যু এবং ৭২৬টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে  শিশুধর্ষণ বেড়েছে ৪১ শতাংশ। ছয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৯৬ শিশু। যা গত বছরের প্রথম ছয় মাসে ছিল ৩৫১। এপ্রিল এবং মে এই দুই মাসেই শিশুধর্ষণ হয়েছে ২৪১টি, যা কিনা মোট ধর্ষণের অর্ধেকেরও বেশি। এই ৪৯৬টি ধর্ষণ হওয়া শিশুর মধ্যে ৫৩টি শিশুকে গণধর্ষণ করা হয়েছে, ২৭টি প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ২৩টি শিশুকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে। এই ছয় মাসে ১২০টি শিশু অপহরণ হয়েছে এবং ৭২টি শিশু নিখোঁজ হয়েছে। অপহরণ হওয়া শিশুদের মধ্যে ৬১ জনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দ্বারা জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু নিখোঁজ হওয়া শিশুদের মধ্যে ২৪ জনকে মৃত পাওয়া গেছে।

বিগত বছরগুলোর নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব অপরাধ বাড়ছে গাণিতিক হারে। ২০১৮ সালে সারা দেশে ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪৩৩ শিশু। এর মধ্যে শুধু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৫৬ জন। ধর্ষণজনিত নির্যাতনে মারা গেছে ২২ শিশু। আর হত্যা ও শারীরিক নির্যাতনের ফলে নিহত হয়েছে ২৪৯ শিশু। এছাড়া ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণচেষ্টা ও নির্যাতনের ফলে আক্রান্ত হয়েছে ১০০৬ শিশু। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ৫৩ জনের ওপর। জাতীয় গণমাধ্যমে ২০১৮ সালে প্রকাশিত খবর পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে সারা দেশে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হয়েছে সাত থেকে দুই বছর বয়সের শিশুরা এবং সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা। নেতিবাচক ঘটনায় গত বছর ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৮১১ জন। এর মধ্যে শুধু শিক্ষকদের দ্বারা ১২৯টি শিশু নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছে। শিক্ষকদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৭টি শিশু, শারীরিকভাবে নির্যাতিত শিশুর সংখ্যা ৭০টি, যৌন হয়রানির শিকার ৩৩টি, ধর্ষণচেষ্টা করা হয়েছে ৭ জনের ওপর।

বেসরকারি সংস্থা নারী পক্ষ বলছে, তারা এক গবেষণার অংশ হিসাবে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ছয়টি জেলায় ধর্ষণের মামলা পর্যবেক্ষণ করেছে। এ গবেষণাটির পরিচালক এবং নারীপক্ষের প্রকল্প পরিচালক রওশন আরা বলেন এ সময়ে ৪৩৭২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে, কিন্তু সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচ জনের।

সংস্থাটি বলছে, ঢাকা ছাড়াও অন্য যেসব জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে - ঝিনাইদহ, জামালপুর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালী।

এ ছাড়া ২০১৮ সালে ২২৭টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যাচেষ্টায় আহত হয় ৪৯টি শিশু। ২০১৭ সালে যার সংখ্যা ছিল ১৯৬ ও ২৮ জন। সে হিসাবে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে শিশু হত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৮ শতাংশ। ২০১৭ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে ধর্ষণ চেষ্টার হার বেড়েছে ১৫ শতাংশ। আমাদের দেশে যে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ক্রমেই বাড়ছে, ওপরের পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

মূলত আমাদের দেশে ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কারণেই রাষ্ট্র কোনো ক্ষেত্রেই পুরোপুরি সফল ও সার্থক হতে পারছে না। ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার কারণে আমাদের দেশের রাজনীতি গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে বলে মনে করা হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থার ওপর। ফলে রাষ্ট্র দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করতে পারছে না।

ধর্ষণের মামলা নিয়ে যেসব নারী আদালতে দাঁড়িয়েছে তাদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। অভিযুক্তের আইনজীবীর দ্বারা তারা এমন জেরার মুখে পড়েন যা তাদের মর্যাদাকে আরো ভূলুণ্ঠিত করে।

গণমানুষের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করা রাষ্ট্র বা সরকারের দায়িত্ব হলেও এ ক্ষেত্রে আমাদের তেমন কোনো সাফল্য নেই। ফলে আমাদের সমাজে অবক্ষয় বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে।

জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল, দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসবে। কিন্তু নির্বাচনের পরের কয়েক দিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংস অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ‘ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে’ ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের দ্বারা এক নারীর গণধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও প্রবল প্রতিবাদ হয়। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ রিমান্ডে নেয়ার পর এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কিছুটা হলেও কমবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু তেমনটি ঘটেনি, বরং একের পর এক ধর্ষণের খবর আসছে।

ধর্ষণ অভিনব কোনো অপরাধ নয় বরং সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথেই ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আর তা দমন, নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত পরিসরে রাখতে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই অপরাধকে দণ্ডবিধির আওতায় আনা হয়েছে। বিভিন্নভাবে এই অপরাধকে সংজ্ঞায়ন ও অপরাধের ধরন মোতাবেক দণ্ডবিধিতে শাস্তির ধরনও বিধৃত হয়েছে। বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা হলো ধর্ষণবিষয়ক ধারা। এ বিষয়ে আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনও রয়েছে। দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। ধর্ষণজনিত কারণে ভিকটিমের মৃত্যু হলে প্রাণদণ্ডের বিধানও রয়েছে আইনে। সার্বিক দিক বিবেচনায় আমাদের দেশে ধর্ষণবিষয়ক আইন বেশ সময়োপযোগী বলেই মনে করা যায়। কিন্তু আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ও দণ্ডবিধির প্রয়োগের অভাবেই এই অপরাধ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ। ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবর যত বেশি পাওয়া যায়, এসব অপরাধের দায়ে অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত তার চেয়ে অনেক কম। অপরাধ করে পার পাওয়া যায়— এ ধরনের বিশ্বাস থেকে অপরাধীরা অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়।

দণ্ডবিধির প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত পরিসরে রাখা সম্ভব হলেও আমাদের দেশে সর্বসাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে গোটা দেশই এখন ধর্ষকদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতিই এর অন্যতম কারণ।

যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রই নাগরিকের সব কিছুই দেখভাল করে, তাই মূল্যবোধের লালন ও চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্বও রাষ্ট্রের। অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে সুশাসনের অভাব, ধর্মবিমুখতা, অসহিষ্ণুতা এবং সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরো কিছু বিষয়।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধই মানুষের জীবন ইতর প্রাণী থেকে আলাদা করে; মানুষকে সভ্য, সংবেদনশীল ও পরিশীলিত রূপ দেয়। পক্ষান্তরে ধর্মহীনতা মানুষকে নামিয়ে দেয় পশুত্বের পর্যায়ে। তাই দেশকে নারী ও শিশুধর্ষণের ভয়াবহতা রোধসহ অপরাধপ্রবণতা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, দণ্ডবিধির যথাযথ প্রয়োগ, নৈতিক শিক্ষার সম্প্রসারণ সর্বোপরি সর্বসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রতকরণের কোনো বিকল্প নেই।

মূলত প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কোনো না কোনো ধর্মকে আশ্রয় করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটি ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে গড়ে উঠেছে। নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি গঠন, অপরাধমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্প্রসারণ, লালন ও অনুশীলন করতে হবে। অন্যথায় সামিয়াদের ভাগ্যবিড়ম্বনার অবসান হবে না।

লেখক: আবদুল্লাহ্ আল মেহেদী

[email protected]

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
তুমি আসবে বলেই আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি এখনো হয়নি: পরীমণি May 05, 2024
img
দেশজুড়ে কালবৈশাখী ঝড়ের সতর্কতা জারি May 05, 2024
img
বাংলাদেশকে ১৩৯ রানের লক্ষ্য দিলো জিম্বাবুয়ে May 05, 2024
img
শুক্রবার ক্লাস নেওয়া নিয়ে ফেসবুক পোস্ট ভুলবশত: শিক্ষা মন্ত্রণালয় May 05, 2024
img
একদিনের ব্যবধানে ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম May 05, 2024
img
পরিবেশ রক্ষায় ঢাকাসহ সারা দেশে গাছ কাটা বন্ধে হাইকোর্টে রিট May 05, 2024
img
মানবপাচার মামলায় ৪ দিনের রিমান্ডে মিল্টন সমাদ্দার May 05, 2024
img
প্রয়োজনে শুক্রবারও ক্লাস নেওয়া হবে: শিক্ষামন্ত্রী May 05, 2024
img
‘জনগণের ভরসাস্থল অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে সেনাবাহিনী’ May 05, 2024
img
মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিরত রাখা দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত : কাদের May 05, 2024