মতিঝিলে সাঈদের টর্চার সেল

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের যুগ্ম আহ্বায়ক মমিনুল হক সাঈদ। এলাকায় গড়েছেন একক আধিপত্য। জড়িয়ে পড়েছেন ক্যাসিনো–বাণিজ্যে। চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগও আছে। প্রভাব খাটিয়ে বনে গেছেন বিভিন্ন ক্লাবের নেতা।

দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা অনলাইন সংস্করণের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সাঈদের নানা ধরনের অপরাধের কাহিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মতিঝিলের দুটি ভবন দখল করে মমিনুল হক সাঈদ গড়ে তোলেন চর্টার সেল। কেউ অবাধ্য হলে কিংবা আদেশ অমান্য করলে তাকে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে তুলে এনে ওই চর্টার সেলে রাতভর দাঁড় করিয়ে পেটানো হতো গিরায় গিরায়। সাঈদের নির্যাতনের শিকার মতিঝিল, আরামবাগ, দিলকুশা এলাকার অনেক ভুক্তভোগী এ তথ্য দিয়েছেন।

খবরে আরও বলা হয়, রাজধানীতে মাদক ও ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হলে গা ঢাকা দেন যুবলীগ নেতা মমিনুল হক সাঈদ। ঢাকা দক্ষিণের যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটকে (ক্যাসিনো সম্রাট) গুরু মানেন তিনি। সম্রাটের অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার দেখভালও করেন তিনি। এ কারণে মতিঝিল ও পল্টন এলাকায় ক্লাবগুলোতে যাতায়াতকারীদের কাছে তিনি ‘ক্যাসিনো সাঈদ’ নামে পরিচিত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মতিঝিলের ৮৯ এবং ৮৯/১ আরামবাগে দুটি ভবন দখল করে রাজাকার ভবন বানান সাঈদ। একটি ভবন ৮ তলা এবং অন্য একটি ভবন ৪ তলাবিশিষ্ট। ভবন দুটি এক সময় হাজির ভবন হিসেবে পরিচিত ছিল।

জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী কেনার পর নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড (বিপিএল) ভবন। পরে এটি স্থানীয়দের কাছে রাজাকার ভবন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী গ্রেপ্তার হওয়ার পরই ওই দুটি ভবনের দিকে নজর পড়ে যুবলীগ যুগ্ম সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদের।

২০১৫ সালের এপ্রিলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হওয়ার পর লাগোয়া দুই ভবনের একটিতে অফিস খোলেন সাঈদ। ২০১৬ সালে মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর ভবন দুটি থেকে মীর কাসেমের স্টাফদের বের করে দিয়ে রাতারাতি দখল করে নেন সাঈদ। এরপর ৮৯ নম্বর আরামবাগের রাজাকার ভবনের দ্বিতীয়তলায় গড়ে তোলেন টর্চার সেল। ভবন দুটির ভাড়াটিয়াদের ডেকে বলেন, এখন থেকে সব ভাড়া আমাকে দেবেন। এরপর থেকে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়া তুলছেন সাঈদের ক্যাডাররা। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং ক্যাসিনো বাণিজ্যে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালেই তাকে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে তুলে রাজাকার ভবনে নিয়ে নির্যাতন করতেন সাঈদ। এ ক্ষেত্রে কেউ নিজ দলের হলেও রেহাই পেতেন না।

সাঈদের ক্যাডার বাহিনীর কেবল দুই রাজাকার ভবন থেকেই চাঁদা এবং ভাড়া নয়, আরামবাগ ফকিরাপুল এলাকার সব দোকান থেকে দিনে ১০০ টাকা করে চাঁদা তোলেন। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে সাঈদের বিরুদ্ধে।

ক’দিন আগেও রাজাকার ভবনে তরুণীদের আনাগোনা দেখা গেছে। পাশের ইয়ংমেনস ক্লাবসহ যেসব ক্লাবে ক্যাসিনো চলত সেখানে সুন্দরী তরুণীদের উপস্থিতি ছিল। ওইসব তরুণী রাজাকার ভবনে থাকতেন বলেন স্থানীয়রা জানায়। সাঈদের ক্যাডাররা রাজাকার ভবনে চালু করেছিল ইয়াবার বারও।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানের মুখে ক্যাসিনো, ইয়াবা বার বন্ধ হয়েছে। সাঈদ পালিয়ে সিঙ্গাপুরে চলে গেছেন। কিন্তু এখনও দুই রাজাকার ভবন রয়েছে সাঈদের অস্ত্রধারী ক্যাডারদের দখলেই। বুধবার সকালে ভবন দুটিতে গিয়ে তাদের তৎপরতা চোখে পড়েছে।

রাজাকার ভবনের এক বাসিন্দা জানান, ‘সাঈদ কাউন্সিলরের অফিসে দোতলার অফিসে প্রায়ই মিটিং হতো। মিটিংয়ের সময় অনেক অস্ত্রধারী আসত। তারা স্থানীয়দের সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ করত।’

আয়নাল হক নামের এক ভাড়াটিয়া বলেন, ‘তাদের অত্যাচারের মাত্রা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, আমরা অনুমান করতে পারছিলাম একটা কিছু হওয়ার সময় এসেছে। সম্প্রতি ছাত্রলীগের ৪ কর্মীকে এখানে এনে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। কারণ তারা সাঈদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ও মতিঝিল থানা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান উদ্দিন জামালের অনুসারী ছিল না।

আয়নাল হোসেন বলেন, সাঈদের টর্চার সেলে ফাইবারের লাঠি দিয়ে পেটানো হতো। বেঁধে রাতভর দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। শরীরের গিরায় গিরায় এবং হাত-পায়ের তালুতে পেটানো হতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানের পর দ্বিতীয়তলার অফিস থেকে নির্যাতন সামগ্রী সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে এখনও তার ক্যাডাররা সেখানে অবস্থান করছে।

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ