রাজনীতিতে মতভেদ থাকতেই পারে; যা কখনো কখনো ব্যক্তিগত রেষারেষির পর্যায়েও চলে যায়। কেউ কেউ আবার সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে একজন “নির্লোভ, নির্ভেজাল এবং নিতান্ত ভালো মানুষ” হিসেবে জায়গা করে নেন মানুষের মনের মনিকোঠায়। সৈয়দ আশরাফ তেমনই একজন নেতা, যিনি তাঁর সততা আদর্শ এবং নিষ্ঠায় ভর করে সিক্ত হয়েছেন আপামর জনতার ভালোবাসায়।
গত ৩ জানুয়ারী থাইল্যান্ডের বামরুনগার্ড হাসপাতলে ৬৯ বছর বয়সে এই মহান নেতার জীবনাবসান ঘটে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি দীর্ঘদিন যাবত ফুসফুস ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
দেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও সৈয়দা নাফিসা ইসলামের বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফের জন্ম ১৯৫২ সালে ময়মনসিংহ জেলায়। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড় সৈয়দ আশরাফ। ১৯৭১ সালে দেশে চলছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের জেলে। বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম তখন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দেশের প্রথম অস্থায়ী সরকাররে রাষ্ট্রপতি। পরম নিষ্ঠা ও বিশ্বাসের সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে। আর তার বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফ সক্রিয়ভাবে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে।
স্বাধীনতার পর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-প্রচার সম্পাদক হিসেবে সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন আশরাফ। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় ৪ নেতাকে নৃশংস ভাবে হত্যার পর পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। সেখানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে রাখেন অসামান্য অবদান।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে কিশোরগঞ্জ ১ আসন থেকে প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে দায়িত্ব পান বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে।
২০০৮ ও ২০১৪ সালে দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী হিসেবে। ২০১৫ সালে দায়িত্ব পান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে। অনেক কঠিন সময়েই তার চওড়া কাঁধে ভর করেছিল পুরো দেশ। ২০০৭ এ জরুরী অবস্থার সময় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা ও তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলে কান্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন আশরাফ। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তানের মতোই তৎকালীন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বুক চিতিয়ে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলেন সামনের সারিতে।
পরবর্তীতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তিনি পর পর দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখনো পর্যন্ত তাকেই ধরা হয় শেখ হাসিনা যুগের এক ও অদ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। কারণ অনেকেরই মতে, তার হাতেই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে।
যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নেয়ার পর থেকেই মোটামুটি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ এর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ টি নির্বাচনের প্রতিটিতেই কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে জয়লাভ করেন আশরাফ। অথচ অসুস্থতার জন্য শেষ নির্বাচনে একটি বারের জন্যেও যেতে পারেননি নিজ নির্বাচনী এলাকায়। কিন্তু মানবতার নেশার পাগল দরদী এই কিংবদন্তীকে ঠিকই মনে রেখেছে তার এলাকাবাসী।
জাগতিক সম্পদের মোহ কখনো ছুঁতে পারেনি তাঁকে। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন নির্লোভ, উদাসীন এবং চরমভাবে মিডিয়াবিমুখ। মন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গুলশানের বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছিল স্ত্রী শিলা ইসলামের চিকিৎসার জন্য। কখনো নেন নি সরকারি বরাদ্দের কোনো প্লট বা শুল্কমুক্ত কোনো গাড়ি।
আওয়ামী লীগ তাঁর কাছে ছিল না শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল বা সংগঠন; আওয়ামী লীগ ছিল তাঁর কাছে একটি অনুভুতির নাম। আশরাফ আমৃত্যু প্রমাণ করে গেছেন তাঁর রক্ত খাঁটি, তাঁর রক্ত পরীক্ষিত। তাঁর শরীরে মৃত্যুর চেয়ে বড় মৃত্যু হয়েছে দেশের একটি আদর্শের, একটি অনুভুতির।
৫৫ হাজার বর্গমাইল হারালো তাঁর সবচেয়ে মিডিয়াবিমুখ রাজনীতিবিদটিকে। ওপারে ভালো থাকবেন সৈয়দ আশরাফ। মনে রাখবেন পরাজিত মানুষের পাশে কেউ হারে না; আপনার শপথ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি জিতে গেছেন। এদেশের রাজনীতিতে বারে বারে জন্ম নিক সৈয়দ আশরাফেরা।
টাইমস/ কেআরএস