একটা বই লিখতে হবে। বিনিময়ে ৩০ হাজার টাকা। মাষ্টার্সে পড়ি, ৩০ হাজার অনেক টাকা। ভদ্রলোকের আজিমপুরে ছয়তলা বাড়ি। ক্যাম্পাসের কাছাকাছি বলে সাতপাঁচ না ভেবেই হ্যা বলে দিয়েছি।
২য় তলা। কলিংবেল চাপার বেশ কিছুক্ষণ পরে এক ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন। ৬৫-৭০ বছরের বয়স, কিন্তু চেহারায় আভিজাত্য। কথা-বার্তায়ও সাহেবি ভাব। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দপ্তরে দায়িত্ব পালন করে অবসরে গেছেন। প্রায় তিনহাজার স্কয়ার ফীটের ফ্ল্যাট। অনেকটা অগোছালো। ত্রিশ মিনিট পার, কিন্তু বাসায় কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেমন যেন ভুতুড়ে অনুভূতি। কোন ধরনের ইনফরমেশন থাকবে, কিভাবে কি লিখব-এসব বিষয় নিয়েই তিনি একনাগারে কথা বলে যাচ্ছেন।
কৌতুহলবশত জানতে চাইলাম, আঙ্কেল বাড়িটা কি নিজের! মিটিমিটি হেসে উত্তর দিলেন-হ্যা কষ্ট করে এই বাড়িটাই করেছি। বসুন্ধরা আবাসিক ও পূর্বাচলে দুইটি প্লট রয়েছে। মিরপুরেও পাঁচ কাঠা জমির উপর ছোট্ট একটা বাড়ি। সম্পদের বিবরণ দিতে গিয়ে সম্ভবত খুব মজা পেয়ে গেছেন। শান শওকতের কথাও বলতে শুরু করলেন, বাথরুমেও বিদেশী টাইলস বসিয়েছেন। পারফিউমটাও লন্ডন থেকে আনেন। ঢাকার পানিতে নানা জীবানু, তাই সিঙ্গাপুরের পানি খান। চা খান জাফরান দিয়ে। কেবল ভোগবিলাসের নানা উপাখ্যান।
হঠাৎ কলিংবেল, শুকনো মুখের একটি ছেলে ঢুকলো বাসায়। আংকেল যেন সম্বিত ফিরে পেলেন, ওহ তোমাকেতো চা খাওয়ানো হয়নি। ছেলেটিকে দ্রুত চা করে দিতে বললেন। এরপর নিজেই বলতে শুরু করলেন- ফ্লাটে একাই থাকি। আনুসাঙ্গিক সবকিছু ওই ছেলেটা দেখাশোনা করে। দুই ছেলে-স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন প্রায় বিশ বছর। দেশে তেমন একটা আসেন না। তিনি বছরে একবার ঘুরে আসেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। নিজের কাছেই অদ্ভুত লাগলো। একজন মানুষের ভোগ-বিলাসের এত আয়োজন। কিন্তু নিকটাত্মীয় কেউ নেই।
জানতে চাইলাম-আঙ্কেল আপনার একা থাকতে খারাপ লাগে না। চেহারায় যেন কাল বৈশাখী মেঘের ছায়া। ভারী হয়ে উঠলো কণ্ঠ। আস্তে আস্তে উত্তর দিলেন-অবসরে যাওয়ার পর থেকে কষ্ট হয়। লোকজন খুব একটা পাশে ঘেঁষতে চায় না এখন। ইচ্ছে হয় খুব, পাশে কেউ থাকলে গল্প করা যেত।
সন্তান-স্ত্রীকে খুব ফিল করি। কিন্তু কিছু করার নেই। নিশ্চিত জীবনের আশায় আমিই ওদেরকে বিশ বছর আগে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম। এখন ওদের জীবন নিশ্চিত, কিন্তু আমাকে দেখার কেউ নেই। মাঝেমধ্যেই শরীর ব্যাথা করে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। খুব ইচ্ছে করে তখন ওরা যদি কেউ মাথায় হাতটা রাখত। রাশভারী মানুষটার চোখে হঠাৎ অশ্রু। এ কেমন জীবন ! প্রিয়জনহীন জীবন।
খ্যাতনামা কলামিস্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর তারেক শামসুর রেহমান। মানুষটির টাকা, পয়সা, যশ খ্যাতির কোনো অভাব ছিলনা। কিন্তু মৃত্যুর সময় কেউ ছিলনা পাশে। মহাকালের পথে পা মেলালেও শিয়রে বসে কেউ ভারি নি:শ্বাসটাও ছাড়েনি। কেউ কোনো কিছু জানতেও পারেনি। একদিন পরে দরজা ভেঙে উদ্ধার হয়েছে লাশ। রক্তবমির মধ্যেই মাথা উপর হয়ে শুয়ে ছিলেন। আহারে জীবন। আহারে স্বপ্নের বিদেশ। আহারে সন্তানদের নিশ্চিত জীবন।
পঞ্চাশোর্ধ্ব এক করোনা রোগী গতকাল সুইসাইড নোট লিখে মুগদা হাসপাতাল থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। পরিবার ও আত্মীয়দের সবাই যুক্তরাষ্ট্রসহ তথাকথিত "উন্নত" দেশে! কিন্তু নিজের জীবনের অনিশ্চিত সময়ে কেউ পাশে নেই। এই একাকিত্ব কত যে কষ্টের, কত যে বেদনার !! জীবনের প্রায়শ্চিত সব মানুষই করতে চায়-কিন্তু সব হারিয়ে হুশ ফিরে। শেষ বিদায়ে কেবল সুইসাইড নোটেই লিখে গেছেন সেই আক্ষেপের কথা, একাকিত্বের গল্প।
অদ্ভুত মানবজীবন। সুখের নেশায় সবাই ছুটে বেশি দামে কেবল দু:খ কেনে। কখনো কখনো সেই ফালতু ইনভেস্টের ফলাফল একাকি মৃত্যু। স্বজনহীন জীবনযাপন। প্রতিটি মুহুর্ত একাকিত্বের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া। তথাকথিত নিশ্চিত জীবনের পিছনে ছুটে আদৌ আমরা কোথায় যাচ্ছি। টাকার পাহাড়ে ঘুমালেও সুখ হারাচ্ছি একটু একটু করে। যখন বোধ আসে, তখন আর সময় ফেরানো যায়না। সুখের মায়ায় যৌথ পরিবার ভেঙ্গে খান খান করে দিয়েছি। সন্তানকে আত্নীয়-স্বজনহীন করে গড়ে তুলছি পশ্চিমা কালচারে। বৈধ-অবৈধ টাকা নিরাপদে রাখতে স্ত্রী-সন্তানকে তথাকথিত উন্নত রাষ্ট্রে অভ্যস্ত করছি। এরপর মৃত্যুর সময়ে কেউ পাশে থাকে না। অদ্ভুত একাকিত্ব। যন্ত্রনাময় একাকিত্ব। লেখক- সাংবাদিক/কলামিস্ট