পহেলা বৈশাখ এলেই চারদিকে পান্তা-ইলিশের রব পড়ে যায়। বাজারেও বাড়তে থাকে ইলিশের দাম। তবে বৈশাখের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও গত কয়েক দশক ধরে একে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার সরেজমিনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর পাইকারি বাজারে জোড়া প্রতি ইলিশ ৫ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। ইলিশের দাম আরো বাড়বে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
লোকগবেষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাণিজ্যিক কারণে পান্তা-ইলিশ আরোপিত সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয় বৈশাখ মাসে ইলিশ খাওয়ার মধ্য দিয়ে সারা বছরের ইলিশ উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাবও পড়ছে। তাই পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে পান্তা-ইলিশের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন তারা।
তাদের অভিমত, বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ঐতিহ্যের সঙ্গে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তারা আগে কখনো বাঙালির এমন সংস্কৃতি দেখেননি। এই ধরনের সংস্কৃতি আধুনিককালের।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা নওশের আলী সিকদার বাংলাদেশ টাইমস’কে বলেন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ও পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ মাছ খাওয়ার সংস্কৃতি দেখিনি। এসব এসেছে ১৯৯০ সালের পর। এখন বছরের একদিন পান্তা-ইলিশ খাওয়াকে প্রথা হিসেবে মানি। আমরা পান্তা-ইলিশের এই সংস্কৃতি চাই না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ও রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনো বাংলাদেশ টাইমস’কে বলেন, পান্তা হচ্ছে আমাদের গ্রামের কৃষকদের খাবার। তারা সকালে এই খাবার খেতে পছন্দ করেন।
‘এছাড়া পহেলা বৈশাখ এলেই অনেকের মধ্যে বাঙালি সাজার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই কারণে এই ইলিশ মাছ আমাদের গরীবরা পায় না। আবার বড়লোকরা এদিন বাঙালি সাজে। অর্থাৎ তারা এটাকে বিজনেস হিসেবে ব্যবহার করছে।’
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস এম রেজাউল করিম (রেজা) বলেন, ২০ বছর আগে কখনও আমি পান্তা-ইলিশ, নতুন জামা-কাপড় পরতে দেখিনি। এসব নিয়ে কোনো ইতিহাস আছে বলেও জানি না। তবে পহেলা বৈশাখ মানুষ পালন করতো অনেক আগে থেকেই।
তিনি আরও বলেন, সম্রাট আকবরের সময় এই প্রথা শুরু হয়েছে। তবে পান্তা ইলিশের প্রথা কখনও শুনিনি। এসব এসেছে আধুনিক যুগে। পহেলা বৈশাখ পালন করাকে এখন প্রতীক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক গিয়াস শামীম বাংলাদেশ টাইমস’কে বলেন, বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে ছায়ানট ও রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া হয়। তবে গ্রাম বাংলায় কোনোকালেও এই খাবারের সংস্কৃতি নেই। বাংলা সংস্কৃতি ধরে রেখেছে গ্রাম বাংলার মানুষ। তারা এখনও বাংলা সনে পথ চলে। তাদেরকেই আমরা বাঙালি বলে থাকি।
তিনি আরও বলেন, তবে শহরে যারা অনেকটা আরোপিত বাঙালি তারা এসব করে থাকেন। তারা বেশ সুন্দর করে পাঞ্জাবি পায়জামা পরে ওই একদিনই বাঙালি সংস্কৃতি পালন করে তা পরিত্যাজ্য বিষয় নয়। তবে ইলিশ খাওয়ার সংস্কৃতি আমাদের সঙ্গে যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউশনের অধ্যাপক এম. আখতারুজ্জামান বাংলাদেশ টাইমস’কে বলেন, গ্রামে মানুষ অনেক আগে থেকে পান্তা খাবারের প্রথা চালু করেছে। এটি যে তাদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি তা তারা জানতেন না। রাতে ভাত খেয়ে একটু পানি দিয়ে রাখলে তা তিনদিন পর্যন্ত থাকে, এটিও তাদের আবিষ্কার। কৃষক যখন সকালে লাঙল নিয়ে কৃষি কাজে বের হন, তখন তারা এই পান্তা যেকোনো তরকারি, কাঁচামরিচ বা ডাল দিয়ে খেয়ে যান।
তিনি বলেন, আমরা তো গ্রামে মানুষ হয়েছি। সেসময় পান্তা খাওয়া আমাদের প্রথা ছিল। তবে শহরের মানুষগুলো বিনোদনের জন্য কোনো কিছু না পাওয়ায় সামর্থ্য অনুযায়ী খাবার খায়। এটাকে আমি ভিন্নভাবে দেখি না। তবে ইলিশ মাছ হচ্ছে আমাদের মাঝে একটি কৃত্রিমতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামসুর রহমান বাংলাদেশ টাইমসকে বলেন, গত বছর পহেলা বৈশাখে প্রধানমন্ত্রী পান্তা-ইলিশ না খেয়ে যদি শুঁটকি ভর্তা খেতে পারেন, তবে আমাদের সমস্যা কোথায়? আর ইলিশ পহেলা বৈশাখে যে খেতে হবে তা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। আর এসময়ে শহরে ইলিশের দামও হয় অনেক। তাই এটি আমাদের সাথে যায় না।
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বাংলাদেশ টাইমস’কে বলেন, পহেলা বৈশাখের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। গ্রাম-বাংলায় নববর্ষের উৎসব ছিল খুব ছোট আকারে। তাই গ্রাম-বাংলার মানুষের সঙ্গে শহরের মানুষের এই কারণে মিলে না।
টাইমস/টিআর/জেডটি