সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ‘রূপলাল হাউজ’

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার মধ্যে যে কয়টিকে ধরা হয়, তার মধ্যে রূপলাল হাউজ অন্যতম। সরকারিভাবে এই স্থাপনাটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সম্পদ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।

কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে রুপলাল হাউজ। এই হাউজটির বেশিরভাগই দীর্ঘকাল ধরে বেদখল হয়ে রয়েছে।

এই হাউজটি পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের পাশে ঊনবিংশ শতকে নির্মিত একটি ভবন। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর পারে ফরাশগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত।

রূপলাল হাউজের একাংশ

ইতিহাসবিদরা বলেন, এই ভবনটি নির্মাণ করেন হিন্দু ব্যবসায়ী ভ্রাতৃদ্বয় রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। দ্বিতল এই ভবনের স্থাপত্যশৈলী অভিনব। যাকে ইউনিক বলেছেন স্থাপত্যবিদরা।

তারা জানান, এই ভবনটি ৯১ দশমিক ৪৪ মিটার দীর্ঘ একটি দ্বিতল ভবন। এটি জমিদার ও বণিকদের তৈরি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এই ভবনটিতে ৫০টির অধিক কক্ষ রয়েছে এবং কয়েকটি প্রশস্ত দরবার কক্ষ রয়েছে। এক সময় রূপলাল হাউজ মসলা ও সবজি ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যায়।

ইতিহাসবিদরা জানান, রূপলাল দাস ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। সামাজিক কর্মকাণ্ডে রূপলাল অনেক অর্থ ব্যয় করতেন।  সেই সময়ে তার অবদানে রূপলাল হাউসে নিয়মিত সংগীতের আসর বসতো। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ ওয়ালী উল্লাহ খান এবং লক্ষী দেবীসহ আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ রূপলাল হাউজে সংগীত আসরে নিয়মিত আসতেন।

ইতিহাসবিদরা আরো জানান, ১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিন ঢাকায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তাদের সম্মানে নাচ গানের আসর কোথায় হবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় আহসান মঞ্জিল এবং রূপলাল হাউজের মধ্যে। এতে অনেক বেশি ভোটে বিজয়ী হয় রূপলাল হাউজ। সেই সময়ে ৪৫ হাজার টাকা ব্যয়ে রূপলাল হাউসের আধুনিকীকরণ করা হয়।

জানা যায়, সেই সময় বিদেশিরা ঢাকায় আসলে রূপলাল হাউজে কক্ষ ভাড়া করে থাকতেন। সেই যুগে কক্ষপ্রতি ভাড়া ছিল ২০০ টাকা।

১৯৪৮ সালে বাড়িটি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সিদ্দিক জামাল নামে একজন দাবি করেন যে তিনি দাস পরিবার থেকে ১৯৭১ সালে রঘুনাথের অংশটি কিনে নিয়েছেন।

সেই সুবাদে তিনি দ্বিতীয় তলায় বসবাস শুরু করেন। তারই সূত্র ধরে সিদ্দিক জামালের মৃত্যুর পর তার ছেলে দাউদ জামাল ১৯৭৩ সালে ভারতে চলে যান। এরপর নুরজাহান ও তার স্বামী দাবি করেন যে, এই অংশটি তাদের এবং তারা বর্তমানে বাড়িটির দখলে আছেন। তারা এখানে গত ৩০ বছর ধরে বসবাস করছেন।

এরপর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার রক্ষীবাহিনীর জন্য বাড়িটি রিক্যুইজিশন করে। রক্ষীবাহিনীর বিলুপ্তির পর ১৯৭৬ সালে রূপলাল হাউজকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

বলা হয়ে থাকে, তখনকার যুগের অত্যন্ত ব্যয়বহুল স্থাপত্য এই রূপলাল হাউস। বাড়িটি ইংরেজি ‘ই’ আকৃতিতে তৈরি। রূপলাল হাউজের ডিজাইন করেছিলেন কলকাতার মার্টিন কোম্পানি।

সরেজমিনে আরো দেখা গেছে, শ্যামবাজারের কাছ ঘেঁষেই সেই রূপলাল হাউজ। আর বাজারের মধ্য দিয়েই একটা আড়ৎ। আড়ৎটাই রূপলাল হাউজের নিচতলার একটা অংশ!

আরো দেখা গেছে, চারিদিকে অসংখ্য দোকান পাটসহ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ভবনটির নিচতলার পুরোটাই চলে গেছে ব্যবসায়ীদের দখলে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গেট দিয়ে ঢোকার পরেই উপরে ওঠার কাঠের সিঁড়ি। তবে তা সবসময় অন্ধকার থাকে। তবে মাঝখানের উঠানটায় রোদের আলো পড়ছে। এটা একটা চতুষ্কোণ বাড়ি।

ভবনটির ছাদ নির্মাণ করা হয়েছিল কোরিনথীয় রীতিতে। এর উপরে রয়েছে রেনেসাঁ যুগের কায়দায় নির্মিত পেডিমেন্ট। ভবনের পশ্চিমাংশে দোতলায় অবস্থিত নাচঘরটি আকর্ষণীয়ভাবে তৈরি। এর মেঝে ছিল কাষ্ঠ নির্মিত।

রূপলাল হাউজকে ঘিরে শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে জনতা কৃষি পণ্য বিপণন কেন্দ্র, বৈশাখী বাণিজ্যালয়, আরাফাত ট্রেডার্স, মেসার্স ঢাকা-বাংলা আড়ৎ, রাশেদ বাণিজ্যালয়, ইউনাইটেড ট্রেডার্স প্রভৃতি।

ব্যবসায়ীরা মন্ত্রণালয় থেকে লিজ নিয়ে ব্যবসা করছেন এবং ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করছেন।

এদিকে রূপলাল হাউজের বর্তমান অবস্থা জানিয়ে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘রূপলাল হাউজ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সম্পদ। এই ভবন নিয়ে আমরা কিছুই বলতে পারবো না।’

এ বিষয়ে রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) সৈয়দ নুর আলম বাংলাদেশ টাইমস’কে বলেন, রূপলাল হাউজও ঢাকার একটি ঐতিহ্য। রূপলাল হাউসের যথাযথ সংরক্ষণ প্রয়োজন। প্রয়োজন মেরামতের। তবে ভবনটিতে নতুন কোনো প্রজেক্ট গ্রহণ করা হয়নি। আমরা দেখভালের বিষয়টি নিয়েও অবগত নই।

আরবান স্ট্যাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম বাংলাদেশ টাইমস’কে বলেন, প্রাচীন এ নিদর্শনগুলো রক্ষা করার জন্য একটি বড় ধরনের বিনিয়োগ সরকারকেই করতে হবে। আর এই ভবনগুলোর যারা মালিক তাদেরকে একটি ক্ষতিপূরণ দিয়ে সরকার জাদুঘর বা প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন করে দিতে পারে।

তিনি বলেন,  পৃথিবীর অনেক দেশে সংরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী এলাকা আছে। আমাদের দেশেও আছে। এতে করে আমাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি বিদেশি অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করা সম্ভব।

এ বিষয়ে প্রত্নতন্ত্র অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) রাখী রায়ের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে প্রত্নতন্ত্র অধিদপ্তরের উপপরিচালক লাভলী ইয়াসমীন বাংলাদেশ টাইমসকে জানান, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। তবে এই বিষয়টি নিয়ে রাখী রায় ভালো বলতে পারবেন। আজ তো তিনি মন্ত্রী সাহেবের সাথে ট্যুরে গেছেন। তাই তার ফোন বন্ধ পাচ্ছেন। 

 

টাইমস/টিআর/জেডটি

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আ.লীগ নেতাকর্মীদের দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর Apr 26, 2024
img
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ চুয়েট, খোলা থাকবে হল Apr 26, 2024
img
প্রথমবার এশিয়া কাপে আম্পায়ারিং করবেন বাংলাদেশের জেসি Apr 26, 2024
img
গাজায় ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে লাগতে পারে ১৪ বছর : জাতিসংঘ Apr 26, 2024
img
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী Apr 26, 2024
img
চলমান তাপপ্রবাহ রেকর্ড ভেঙেছে ৭৬ বছরের Apr 26, 2024
img
অলসতা কাটিয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠতে করণীয় Apr 26, 2024
img
বাংলাদেশে চিকিৎসা সুবিধায় থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী Apr 26, 2024
img
চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি Apr 26, 2024
img
সেন্সর বোর্ডে আটকে গেল রায়হান রাফীর নতুন সিনেমা ‘অমীমাংসিত’ Apr 26, 2024