রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা বাবার নাম, যা বললেন মেয়ে

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। রোববার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তালিকা প্রকাশ করেন মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

প্রকাশিত রাজাকারের তালিকার ৬৩ নম্বরে নাম এসেছে বরিশালের গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তপন কুমার চক্রবর্তী ও তার মা ঊষা রানী চক্রবর্তী (সিরিয়াল-৪৫)।

মুক্তিযোদ্ধা বাবার নাম রাজাকারের তালিকায় থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তপন কুমার চক্রবর্তীর মেয়ে ডা. মনীষা চক্রবর্তী। মনীষা চক্রবর্তী বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বরিশাল জেলা শাখার সদস্য সচিব।

সোমবার নিজের ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ টাইমস এর পাঠকদের জন্য তার ফেসবুকের বক্তব্যটি হুবুহু তুলে ধরা হল।

“বন্ধুগণ আপনারা সকলেই জানেন আজকে মহান বিজয় দিবস। আজকে সকালেও বিজয় দিবস উপলক্ষে আমাদের দলীয় কর্মসূচিতে আমরা যখন ছিলাম তখন পর্যন্ত আমরা জানতাম না যে আসলে কি রকম একটা খবর আমাদের কাছে পৌঁছাতে যাচ্ছে।

আমরা যখন এই খবরটা প্রথম শুনি তখন আসলে আমি প্রথমে ভেবেছি নিশ্চয় কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। কারণ বিষয়টি এতটাই অপ্রত্যাশিত এবং এতটাই অবিশ্বাস্য যে আসলে বিষয়টি এটা ধারণ করতে আমার বেশ খানিকটা সময় লাগে। এবং আমি আসলে যতক্ষণ পর্যন্ত গেজেটটি নিজের চোখে না দেখেছি ততক্ষণ পর্যন্ত আমি পুরোপুরি ঘটনাটি বিশ্বাস করতে পারিনি।

যখন সত্যি সত্যি গেজেটে আমি দেখলাম ওখানে আমার বাবা যিনি হচ্ছেন বরিশালের সর্বজন পরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং উনি এখানকার এই ৯ নাম্বার সেক্টরের মেজর জলিলের আন্ডারে যুদ্ধ করেছেন। তার সাথের অনেক সহযোদ্ধারা বরিশালে অবস্থান করেন। তারা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এমনকি বর্তমানে যে কমান্ডার এবং যে সেক্রেটারি তিনি তারা সবাই কিন্তু আসলে বাবার সাথে একসাথে যুদ্ধ করেছেন। এরকম একজন মানুষকে যে একটা রাজাকারের তালিকায় তার নাম দেয়া যেতে পারে এই ধরণের একটি প্রক্রিয়া যে বাস্তবিকভাবে সম্ভব সেটা আসলে আজকের এই অভিজ্ঞতা না হলে হয়তো আমি কোনদিনই বিশ্বাস করতাম না।

আরও একটি বিষয় হচ্ছে যে, এখানে আরও একটি নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যেটা হচ্ছে আমার ঠাকুর মা উষা রাণী চক্রবর্তীর নাম। উষা রাণী চক্রবর্তী সেই সময়ে এখানে বরিশালের বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম ফাস্ট ডিভিশন পাওয়া মহিলা। এবং উনি ওই সময়ে বিদুষী নারীদের মধ্যে বরিশালে অন্যতম ছিলেন। সেই সময়ে উষা রাণী চক্রবর্তী তার স্বামীকে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন। যখন ৭১ সালের ১২ই আগস্ট আমার দাদুকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে যায়, তিনি তখন সেই ঘরে অবস্থান করছিলেন। তিনি তার অন্যান্য সন্তানদেরকে নিয়ে পরে গ্রামের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন।

কিন্তু তিনি যে তার স্বামীকে মুক্তিযুদ্ধে হারালেন। তার যে এই আত্মত্যাগ, সেই আত্মত্যাগের মূল্যায়ন কোন দিনও আমাদের রাষ্ট্র কখনোও দেখিনি যে একটা শহীদ পরিবারকে সেই মর্যাদা দিয়ে করেছে।

এখন আজকে এই স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে এসে মূল্যায়ন তারা করলেন তার নামটা রাজাকারের তালিকায় দিয়ে। যখনই এই ঘটনাটা ঘটল তার পরেই আমরা যখন বাসায় ফিরলাম আমার বাবা স্বাভাবিকভাবেই বিজয় দিবসের সকালে উঠে একজন মুক্তিযোদ্ধা তিনি নিশ্চয় এই খবরটি প্রত্যাশা করেননি। একজন মুক্তিযোদ্ধা যিনি তার জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন। সম্মুখ সমরে গিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি নিশ্চয় যে দেশের জন্য তিনি যুদ্ধ করেছিলেন, যে বিজয়টি তার মতো অসংখ্য মানুষের সশস্ত্র যুদ্ধর মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে। সেই বিজয় দিবসের দিন সকালে উঠে একজন মুক্তিযোদ্ধা যখন নিজের নাম রাজাকারের তালিকায় দেখেন তখন আসলে শুধু একজন মানুষের অপমান হয়না, তখন আসলে শুধু একজন ব্যক্তির অপমান হয়না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে যদি আদৌও যদি কিছু থেকে থাকে সেই চেতনাটা যদি কিছু মানুষও ধারণ করেন, সেই চেতনাধারী প্রত্যেকটা মানুষের আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র চেতনার অপমান হয়।

আজকে এই অপমানটা শুধু আমাদের বাবাকে করা হয়নি। এই অপমানটা শুধু আমার ঠাকুরমাকে করা হয়নি। এই অপমানটা শুধু আমার পরিবার বা আমার দলীয় পরিমণ্ডলের অপমান এখানে করা হয়নি। এই অপমানটি আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই করা হয়েছে। এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে এখানে যে নানান রকমের উদ্দেশ্য, নানান রকমের স্বার্থসিদ্ধির যে পায়তারা হয় সেই বিষয়টি এখানে আসলে আবারও প্রমাণিত হলো।

এই ঘটনাটি কেন ঘটেছে? এই ঘটনাটি ঘটেছে কারণ বরিশালে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বাসদ এখন একটি প্রতিপক্ষ শক্তির জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে। আপনারা দেখেছেন যে, এর আগেও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা এখানে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামে ছিলাম। যে বিষয়টি নিয়ে আসলে বরিশালের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের কেউই সেইভাবে কথা বলার মতো সাহস আমরা দেখিনি।

সে বিষয়টির কারণেই কিন্তু যেটি হয়েছে যে এখন যেহেতু প্রতিপক্ষ হিসেবে আমরা এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছি। গণমানুষের কণ্ঠস্বর, সেটা আমাদের কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে যাচ্ছে এবং নানান রকম লুটপাট দুর্নীতির চিত্র সেগুলো আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরছি।

আমরা বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের যে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির কথা সেটা আমরা জনগণের সামনে জোড় গলায় বলেছি। আমরা এখানকার রাস্তাঘাট, এখানকার সমস্ত জনজীবনের সংকট নিয়ে সবসময় সোচ্চার ছিলাম। এবং সেই সোচ্চার থাকার ফলাফল হিসেবে হয়তোবা আজকে আমার বাবার ঠাই হয়েছে রাজাকারের তালিকায়। আজকে এই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে দেয়া, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার জন্য অনেক রকম নোংরা পদ্ধতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা দেখেছি। কিন্তু এবারের যে পদ্ধতি এই পদ্ধতির মতো নোংরামি আমার মনে হয় যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা রেকর্ড হয়ে থাকবে। এই ধরণের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এত নিচুতে যে কোন রাজনৈতিক শক্তি নামতে পারে এটা আসলে আমাদের জন্যও একটি শিক্ষা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা ব্যবহার করে, আজকে রাজাকারের তালিকায় তারা একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম দিয়ে তারা মনে করছেন যে, আজকে এইভাবে কোন শক্তিকে তারা দমন করতে পারবেন। আমরা এর আগেও নানান রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। বরিশালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে- যেমন ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে সেখানে আমাদের অফিসে গিয়ে সেখানকার আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি তিনি বলে এসেছেন যে এই অফিসটা বন্ধ করে দিতে হবে। এবং এইভাবে নানান জায়গায় নানান রকম ঘটনা ঘটছে। এই বিষয়গুলো আমরা এমনকি সরকারি দলকে জানিয়েছি। কিন্তু আমরা কখনোও দেখেছি যে, আসলে সেখানে কোন ধরনের পদক্ষেপ যে সেখানে নেয়া হয়নি। আমরা মনে করি যে, এই যে ধারাবাহিকভাবে আমাদের সাথে একধরণের প্রতিপক্ষ হিসেবে আমাদেরকে নেয়ার যে মানসিকতা সেটারই একটি পরিণতি হিসেবে আজকের এই ফলাফলটি ঘটলো। এবং দেখেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সেই মন্ত্রণালয় আমার বাবাকে একটি সনদপত্র দিয়েছিল ২০০২ সালে। তারা আবার গেজেটের মাধ্যমে বাবাকে মে ২১, ২০০৫ সালে ১শ ১১ নাম্বার তালিকায় বাবাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

সেই স্বীকৃতি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ই দিয়েছিল। আবার সেই মন্ত্রণালয়ই আমরা দেখলাম যে বাবাকে আবারও আরেকটি গেজেটের মাধ্যম তারা এখানে, তারা এখানে আরও একটি গেজেটের মাধ্যমে স্বীকৃতি নতুনভাবে তারা আরও একটি স্বীকৃতি দিলেন, যেটি হচ্ছে গিয়ে এই যে, ৬৩ নাম্বার এটা হচ্ছে রাজাকারের নতুন যে তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় দিয়েছে। এখানে ৬৩ নাম্বাররে তপন কুমার চক্রবর্তী, সুধিরকুমার চক্রবর্তী তারা তাকে রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করলেন।

আমার প্রশ্ন এখানে যাকে বাংলাদেশ গেজেটে তারা ১১১ নম্বরে তপন কুমার চক্রবর্তী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একজন কে তালিকাভুক্ত করেছেন। আর ঠিক একই তপন কুমার চক্রবর্তী, সুধির কুমার চক্রবর্তীর সন্তানকে তারা গতকালকে রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করলেন। একদিকে তারা উনাকে রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছেন আরেক দিকে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে তিনি একজন ভাতা সম্মানী ভাতা সেই ভাতাও তিনি এখানে উপভোগ করেন। এখানে দেখেন যে, তার এই বিষয়টি কিন্তু এখানে একেবারে মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক স্বীকৃত।

তাহলে আসলে মানে এই বিষয়টি নিয়ে এই বিষয়টি যে কতখানি ভিত্তিহীন। এই বিষয়টি যে কতখানি অর্থহীন এবং এই বিষয়টি আসলে যে নোংরা রাজনীতির একটা দিককে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে এটা বলার আর অপেক্ষা রাখেনা।

যারাই চক্রান্তের সাথে যুক্ত, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যে পুঁজি করে কতখানি নিজে নিজেদেরকে নিচে নামাতে পারে। তার একটি উদাহরণ তারা আজকে তৈরি করলেন। এবং আমরা বলতে চাই এই ঘটনা দিয়ে আমাদেরকে দমানো বা এই ঘটনা দিয়ে আমাদের মনোবল ভাঙার স্বপ্ন যারা দেখেন তাদের আসলে বুদ্ধিমত্তা বা তাদের আসলে বোধ বুদ্ধি বা তাদের বিবেচনা এটা নিয়ে আমাদের একটু সন্দেহই হয়।

কারণ আসলে এই রকম নোংরামি করে কাউকে থামানো যাবে বা এই রকম নোংরামি করে প্রতিপক্ষকে থামিয়ে দেয়া যাবে। সেই রাজনীতি বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ করেনা। আমরা আমাদের জনগণের প্রতি আমাদের যে দায়বদ্ধতা সেই জায়গা থেকে আমরা আগেও রাস্তায় থেকেছি, আমরা এখনও রাস্তায় থাকব। এই বিষয়টিও যেহেতু একটি অন্যায় হিসেবেই আমাদের সামনে চিত্রিত হয়েছে। একটি অনৈতিক জায়গা হিসেবে চিত্রিত হয়েছে, আমরা এর বিরুদ্ধেও আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব। এই গেজেটটি বাতিল করার দাবি আমরা জানাচ্ছি।

একই সাথে আমরা দাবি জানাচ্ছি, এই তথ্যগুলি যারা দিলেন এবং এই রকমভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে, ৭৬ বছর বয়সী একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিজয় দিবসের দিনে যারা এরকম অপমান করলেন তাদের শাস্তি আমরা দাবি করছি।

আমরা দাবি করছি যে, এই রকম মিথ্যা তথ্য গেজেটে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, যারা এখানে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের এখানে বিচার হওয়া দরকার। এরকম একটি ভুল, একটি অন্যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা যারা করেছেন তাদের শাস্তি আমরা দাবি করছি।

এই পর্যন্তই বলার ছিল। আর একই সাথে যে বিষয়টা কালকে ১১টার সময় আমরা এই বিষয়টা নিয়ে একটা সংবাদ সম্মেলন করব বাসদ কার্যালয়ে। তারপরই এই বিষয়টা নিয়ে আমরা একটি প্রতিবাদ মিছিল করব। ধন্যবাদ সবাইকে।”

 

টাইমস/আরএ/এএইচ/এইচইউ

Share this news on: