ডাক্তার বনাম শাবানার ঠেলাগাড়ি

রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। দ্রুত অপারেশন করতে হবে, নয়তো বাঁচবেন না। তাকে বাঁচাতে হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫০ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। অন্যথায় অপারেশন হবে না বলে রোগীর স্বজন শাবানাকে জানাল ডাক্তার। এর পরের দৃশ্য শাবানা ঝড়-তুফানের মধ্যে ঠেলাগাড়িতে করে স্বজনের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। তখন তার মাথায় ঢুকল ডাক্তার একটা ‘জানোয়ার’।

সিনেমায় দেখা যায়, নায়ক ডাক্তারের কলার ধরে বলছে “ওই কুত্তার বাচ্চা আমার ভাইয়ের যদি কিছু হয়, তোরে মাইরা ফালামু, অই-অই-অই ডাক্তারের বাচ্চা তোরে কইয়া দিলাম।” সিনেমার এমন ডায়লগে আমরা ধরে নিলাম- ডাক্তারকে এভাবে না বললে হয়ত কাজ হয় না।

এভাবেই ডাক্তারের ইমেজটাকে আমাদের সামনে বিভিন্ন দিক থেকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে তাতে সাধারণ মানুষের মগজে ঢুকে গেছে ডাক্তার মানেই একজন ‘কসাই’।

মজার ব্যাপার হচ্ছে পুলিশ বা প্রশাসনে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাদের হেনস্তা বা পেটানোর সাহস কারও হয়না। কারণ একজনের আছে বন্দুক, অপরজনের আছে ক্ষমতা। এমনকি ডাক্তার পেটানো নায়কও সিনেমার দৃশ্যে অনেক সময় পুলিশ দেখে পালায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কোনো পেশাকে ঢালাও ভাবে খারাপ বলা বা টার্গেট করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? খারাপ হয় মানুষ, সে যেকোনো পেশায় থাকতে পারে। সেজন্য কেউ অপরাধ করলে তার বিচার হবে। কিন্তু আমরা ডাক্তারদের যেভাবে গণহারে ভিলেন বানাচ্ছি, তাতে প্রকারান্তরে ক্ষতিটা কার হচ্ছে?

ডাক্তাররা যদি ঠিকমতো চিকিৎসা নাই দেন, তাহলে সরকারী হাসপাতালগুলোতে হাজার হাজার রোগী কি বেড়াতে যায়? একেকটি হাসপাতাল সক্ষমতার তিন-চারগুণ বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেয়। স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক হাসপাতালের বারান্দায় রোগীদের পড়ে থাকতে দেখা যায়। ডাক্তারদের ভিলেন বানানোর আগে এসব পরিস্থিতির উন্নয়নে আমরা কি পদক্ষেপ নিয়েছি?

সম্মানিত সংসদ সদস্যদের প্রতি পরামর্শ। আপনারা নিজ নিজ এলাকার হাসপাতালগুলোতে যে পরিমাণ রোগী ভর্তি রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের শয্যার ব্যবস্থা, রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও ওষুধের ব্যবস্থা করুন। মূল সমস্যা এটাই।

আমাদের দেশের বাজেট বরাদ্দের বড় অংশ যায় স্বাস্থ্য আর শিক্ষা খাতে। এতো টাকা কই যায়, একটু সরেজমিনে দেখবেন? এসব একটু ভাইরাল করবেন? আমি বলছি না ডাক্তার সবাই ধোয়া তুলশী পাতা। ‘বদের হাড্ডি’ সব পেশাতেই আছে। যারা এমন তাদের জন্য একটা আইন করেন। যেখানে পাবলিকের হাতে বিচার তুলে দিয়ে নয়, বরং যথাযথ মাধ্যমে তদন্ত করে ডাক্তারের অনুপস্থিতি, অবহেলা ও ভুলের প্রমাণ হলে কঠোর থেকে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত হয়।

আবার অনেক সময় দেখা গেছে- এক ডাক্তারের রোগী অন্য ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি বলেন, “আরে আপনাকে খামাখা এসব টেস্ট করিয়েছে কেন? অথবা এ রোগের জন্য-তো অপারেশন লাগবে না, ওই ডাক্তার কেন এসব বলল বুঝলাম না।” রোগীকে এসব বলার ফলাফল কি দাড়ায়?

ডাক্তার সাহেবদের সংগঠনগুলো কেন বর্তমান পরিস্থিতি উন্নয়নে এগিয়ে আসেন না, তাও বুঝে আসে না। সে জন্য বলা যায়- রোগী ও ডাক্তার উভয় পক্ষেরই আস্থার সংকট রয়েছে। তাই আপনাদের এগিয়ে আসা উচিত, নাকি?

হাসপাতাল ও ডাক্তার সবকিছু ঠিক হলেও পরিস্থিতির কতটুকু উন্নতি হবে জানি না। কারণ, আমরা সাধারণ পাবলিক এতো ইনটেলিজেন্ট, যে সাধারণ সর্দি-কাশি হলে এফসিপিএস খুঁজি, আর টিউমার-ক্যান্সারের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথী খাই। এছাড়া সব মৃত্যুর পেছনে কাউকে না কাউকে দোষ দেই, যেমন হার্টএ্যাটাক বা স্ট্রোক হলে আগে বলতাম ‘শয়তানের বাতাস’ লেগে মারা গেছে এখন বলি ‘ডাক্তার মারছে’।

লেখক: হোসাইন শাহিদ, ব্যুরো প্রধান, যমুনা টিভি, ময়মনসিংহ। 

 

টাইমস/জিএস

Share this news on: