বাজেট পাসের আগেই মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেটে বাড়তি শুল্ক কেন আরোপ করা হয়েছে, মোবাইল অপারেটরদের কাছে তা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এ বিষয়ে মোবাইল অপারেটরদের কড়া ভাষায় শাসিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে মোবাইল সেবার ওপর সরকারের প্রস্তাবিত বর্ধিত সম্পূরক শুল্ক কার্যকর করার কারণে মোবাইল অপারেটরদের শাসানো বা সতর্কীকরণ চিঠিকে ভালো ভাবে নেননি বিশ্লেষকরা। অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করছেন, সরকারের রাজস্ব বিভাগ ও বিটিআরসি’র দ্বিমূখী আচরণ ভালো কোনো ফল দেবে না। তার চেয়ে বরং সম্পূরক শুল্ক বা মোবাইল সেবা খাতে খরচ আরও কমানো উচিত।
এর আগে গত শনিবার দেশে কর্মরত সবকটি মোবাইল অপারেটরকে ই-মেইল পাঠানো হয়। বিটিআরসির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ফারহান আলমের ই-মেইল থেকে সব অপারেটরদের কাছে ই-মেইলের মাধ্যমে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে তিনি নিজেই নিশ্চিত করেছেন।
মোহাম্মদ ফারহান আলম জানান, আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল সেবার ওপর যে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, তা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু মোবাইল অপারেটরগুলো বাজেট কার্যকরের আগেই প্রস্তাবিত নিয়ম বাস্তবায়ন শুরু করেছে। যা বেআইনী।
জানা গেছে, ই-মেইল বার্তার মাধ্যমে পাঠানো চিঠিতে মোবাইল অপারেটরদের উদ্দেশ্যে বিটিআরসি বলেছে, বাজেটে যে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, তা এরই মধ্যে আরোপ করা শুরু করে দিয়েছে অপারেটরেরা। বিষয়টি বিটিআরসির নজরে এসেছে। এটা প্রমাণিত হলে অপারেটরদের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে অপারেটরদের বিরুদ্ধে কি ধরণের কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসি জানিয়েছে, অপারেটরগুলোর জন্য সব ধরনের অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দেয়া বন্ধ করা হবে। এছাড়া অন্যান্য সব সেবা ও ট্যারিফ অনুমোদন বন্ধ করে দেয়া হবে।
তবে জানা গেছে, জাতীয় সংসদে যেদিন বাজেট ঘোষণা করা হয়, সেদিন থেকেই নতুন শুল্ক কার্যকর হয়ে যায়। অর্থবিলের ৮৮ পাতায় কোন কোন দফা অবিলম্বে কার্যকর হবে, তা উল্লেখও করে দেয়া হয়। এর আওতায় ৮০ নম্বর দফাও সংযুক্ত রয়েছে। আর ওই দফার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মোবাইল সেবা।
এব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, সম্পূরক শুল্ক ও অন্যান্য শুল্ক আরোপ করা হলে সেটা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়। কারণ, তা না হলে অপব্যবহার করার সুযোগ থাকে। যেমন, বাজেট ঘোষণাকালে যদি গাড়ি ক্রয়ের ওপর শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয় এবং তা কার্যকর হয় জুলাই থেকে। তাহলে ব্যবসায়ীদের মাঝে বেশি পরিমাণে গাড়ি আমদানি করে রাখার প্রবণতা দেখা দেয়। এটা সকল ক্ষেত্রেই দেখা গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ আরও বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে শুল্ক কার্যকর করার এই রীতি ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে। তবে আমরা মাঝে দুই বছর এই নিয়ম বাদ দিয়েছিলাম। পরে আবার আগের রীতিতে ফিরে গেছি।
তবে মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন এনবিআরের সাবেক এই প্রধান। তিনি বলেছেন, মোবাইল সেবার অধিকাংশ উপকারভোগী সাধারণ মানুষ। সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করলে সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষই বেশি সেবা বঞ্চিত হবে।
এব্যাপারে বিশ্লেষকরা বলছেন, মোবাইল সেবায় কর বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষ বেশি চাপে পড়বে। কারণ প্রতি বছরই মোবাইল সেবার ওপর কর বাড়ানো হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এই খাত হয়তো একসময় সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাবে।
এনবিআর ও মোবাইল অপারেটরদের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল সেবা, তথা কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার ও খুদে বার্তা পাঠানোর ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করেছে সরকার।
গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে বাজেট ঘোষণা করেন। ওই দিন রাতেই কোনো কোনো মোবাইল অপারেটর বর্ধিত সম্পূরক শুল্ক কার্যকরের কথা জানায়।
এদিকে নতুন করহারে মোবাইল সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ১৫ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ ও সারচার্জ ১ শতাংশ হওয়ায় মোট করভার দাঁড়িয়েছে ৩৩.৫৭ শতাংশ।
অর্থাৎ এখন থেকে গ্রাহকের প্রতি ১০০ টাকা রিচার্জে সরকারের কাছে কর হিসেবে চলে যাবে ২৫ টাকার কিছু বেশি। এত দিন এই করের পরিমাণ ছিল ২২ টাকার মতো।
এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোবাইল সেবার ওপর প্রথম ১ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আরোপ হয় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ও ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। আর চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সম্পূরক শুল্ক আরও বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
এদিকে শীর্ষ দুই মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি জানিয়েছে, তাদের মোট আয়ের ৫৩ থেকে ৫৬ শতাংশ অর্থই সরকারের কোষাগারে বিভিন্ন কর, ফি বা মাশুল হিসেবে চলে যায়।
টাইমস/এসএন